স্বরেসকে মি. স্বরেস বলার কাষ্ঠ সৌজন্য লোপ পেয়েছে বহু বছর আগেই। স্বরেস এখন। শুধুই স্বরেসমিস্টার-ফিস্টারের বালাই নেই। ভদ্রলোক উইন্ডভেন অ্যান্ড ওয়াটারফল ট্রাস্ট কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। কোম্পানিটা বিরাট। এই পৃথিবীতে যাঁর যত বিদ্যুৎশক্তি দরকার, সবই জোগান দিচ্ছে এই কোম্পানি। দুনিয়ার সমস্ত জলচক্র আর জলপ্রপাতের মালিক এই একটা কোম্পানি। ফলে, পৃথিবী গ্রহটার জল পাম্প করে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করার অধিকার রয়েছে কেবল এই কোম্পানিরই। ভদ্রলোক থাকেন লন্ডনের সেভেন্থ ওয়ে অঞ্চলের একটা পেল্লায় হোটেলে-সতেরোতলার একটা অতীব আরামপ্রদ এবং সুবিশাল ফ্লাটে। ভিক্টোরীয় আমলের বাবুগিরির ইতি হয়ে গেছে। অনেককাল আগেই–ঝি-চাকর-খানসামা রেখে নবাবি চালে থাকার সাধ থাকলেও সাধ্য হয় না কারওই। বাড়ি ভাড়া আর জমির দাম যে হারে বেড়েছে এবং ঝি-চাকরের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে রান্নাবান্নার যান্ত্রিক ব্যবস্থার এমন উন্নতি ঘটেছে যে, আলাদা বাড়িতে পৃথক ঘরকন্না করার রেওয়াজও লোপ পেয়েছে। দলছাড়া হয়ে থাকা এ যুগে বর্বর বিলাসিতার শামিল। এহেন অ্যাপার্টমেন্টে সাজগোজ শেষ করে স্বরেস গিয়ে দাঁড়ালেন। একটা দরজার সামনে। দুটো দরজা আছে অ্যাপার্টমেন্টে–এক-এক প্রান্তে একটা। প্রত্যেক দরজার ওপর বিশাল তির চিহ্ন-নিশানা করছে বিপরীত দরজার দিকে। বোতাম ছুতেই খুলে গেল দরজা। চওড়া গলিপথে এসে দাঁড়ালেন স্বরেস সাহেব। গলিপথের ঠিক মাঝখানে সারি সারি চেয়ার পাতা রয়েছে–ধীরস্থির গতিবেগে চেয়ার সরে যাচ্ছে বাঁদিকে। ঝলমলে পোশাক-পরা নরনারী বসে কয়েকটি চেয়ারে। পরিচিত একজনকে অভিবাদন জানালেন বাতাসে মাথা ঠুকে। কথা বললেন না। এ যুগে প্রাতরাশ খাওয়ার আগে কথা বলাটা শিষ্টাচার নয় মোটেই। টুপ করে বসে পড়লেন একটা চেয়ারে। চলন্ত চেয়ার গিয়ে দাঁড়াল লিফটের সামনে। লিফটে করে নেমে গেলেন বিশাল হলঘরে। বসে রইলেন। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় প্রাতরাশ পরিবেশনের প্রতীক্ষায়।
ভিক্টোরীয় যুগে যে ধরনের প্রাতরাশ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল–এ প্রাতরাশ কিন্তু সে প্রাতরাশ নয়। এক ধ্যাবড়া ময়দার তাল থেঁতলে চটকে বেঁকিয়ে সেঁকে পশুচর্বি মাখিয়ে সুস্বাদু করা হত তখন। সেই সঙ্গে থাকত সদ্যনিহত পশুমাংস–যা দেখলেই চেনা যেত কোন পশুর মাংস। কদাকারভাবে ঝলসিয়ে নির্মমভাবে কেটেও টুকরো টুকরো চেহারা পালটানো যেত না। নিষ্ঠুরভাবে ডিম কেড়ে আনা হত মুরগির বাসা থেকে, মুরগি বেচারির কোঁকর-কোঁ আপত্তিতে কর্ণপাতও করা হত না। ভিক্টোরীয় যুগে এসবই ছিল মামুলি ব্যাপার–কিন্তু পরবর্তী এই যুগের মানুষদের মার্জিত রুচি বরদাস্ত করতে পারে না এহেন জঘন্য আহার। বিভীষিকা এবং বিবমিষায় শিউরে ওঠে। কুৎসিত এইসব খাবারদাবারের বদলে আছে বিভিন্ন রঙের এবং আকারের নয়নসুন্দর কেক আর পেস্ট। রং দেখে বোঝাও যাবে না, রাঁধা হয়েছে কোন পশুর উপাদান আর রস থেকে। একধারে আছে ছোট্ট একটা বাক্স। বাক্সর ভেতর থেকে রেললাইনের ওপর দিয়ে হড়কে বেরিয়ে আসবে একটার পর একটা ডিশ ভরতি এইসব পেস্ট আর কেক। ঊনবিংশ শতাব্দীর মানুষ টেবিলের ওপরে হাত বুলিয়ে অথবা এক ঝলক দেখেই মনে করতে পারে, খুব মিহি সাদা বুটিদার কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে টেবিল। কিন্তু মোটেই তা নয়। অক্সিডাইজড ধাতু দিয়ে ঢাকা এই টেবিল খাওয়ার পরেই সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে নেওয়া যায়। এই ধরনের কয়েকশো ছোট টেবিল রয়েছে হলঘরে। বেশির ভাগ টেবিল দখল করে বসে রয়েছে পরবর্তী এই যুগের মানুষরা–কোথাও একা, কোথাও দল বেঁধে। স্বরেস বসলেন এইরকমই একটা টেবিলে। অদৃশ্য অর্কেস্ট্রা নীরব ছিল বিরতির সময়ে। উনি বসতেই আরম্ভ হয়ে গেল শ্রুতিমধুর বাজনা।
প্রাতরাশ বা সংগীত নিয়ে বিভোর হয়ে রইলেন না কিন্তু স্বরেস। চোখ ঘুরতে লাগল হলঘরে। যেন কারও আসার প্রতীক্ষায় রয়েছেন। একটু পরেই দেখা গেল তাকে। দীর্ঘদেহী কৃষ্ণকায় এক পুরুষ। পরনে হলুদ এবং জলপাই-সবুজ পরিচ্ছদ। ঘরের শেষ প্রান্তে তাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সাগ্রহে হাত নেড়ে ডাকলেন স্বরেস। আগন্তুক এগিয়ে এল টেবিলের আশপাশ দিয়ে। অস্বাভাবিক তীব্রতা প্রকট হল দুই চোখে-মূর্ত হল আত্যন্তিক ব্যগ্রতা মুখের পরতে পরতে। বসে পড়লেন স্বরেস-হাতের নির্দেশে বসতে বললেন পাশের চেয়ারে।
বললেন, দেরি দেখে ভাবলাম বুঝি আর আসবেন না।
সময়ের দুস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষাটা কিন্তু পালটায়নি–ভিক্টোরীয় আমলে যা ছিল, এখনও রয়েছে ঠিক তা-ই। ফোনোগ্রাফ মেশিনের এবং ওই জাতীয় বিবিধ রেকর্ডিং মেশিনের আবির্ভাবের ফলে এবং আস্তে আস্তে কেতাবজাতীয় পদ্ধতিগুলো অপসৃত হওয়ার দরুন মানুষের চোখই যে কেবল অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেয়েছে তা-ই নয়, মোটামুটি নিশ্চিন্ত একটা মান বজায় রাখতে পেরেছে ইংরেজি ভাষা–উচ্চারণ আর পালটায়নি–আগে যা ঘটতই, আটকানো যেত না।
সবুজ আর হলুদ পোশাক-পরা পুরুষ বললে, কৌতূহলোদ্দীপক একটা কেস নিয়ে আটকে পড়েছিলাম। নামকরা এক রাজনীতিবিদ অতিরিক্ত পরিশ্রমের দরুন কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমাইনি এঁর জন্যে।