ডেনটনের হাত ধরে এলিজাবেথিটা নিয়ে এল উড়ুক্কু যন্ত্রযানের সেই মঞ্চাসনে–পাঁচ বছর আগে যেখানে বসে ভবিষ্যতের সুখের স্বপ্ন দেখেছিল দুজনে। নিবিড় কণ্ঠে বললে ডেনটনকে, কেন এত মনস্তাপ? ডেনটনকে বিয়ে করে তো অসুখী নয় এলিজাবেথিটা? দুর্ভোগ এসেছে তো আসুক-না কেন–পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়ে যাবে দুজনে।
হাত ধরাধরি করে নেমে এল দুজনে–গেল লেবার কোম্পানির দরজায়।
দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবেই প্রথমদিকে কাজ করে গেছে লেবার কোম্পানি। যে এসেছে দরজায়, তাকেই দিয়েছে খাদ্য, মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দিনভর কাজের সুযোগ। কোম্পানি গঠনের শর্তই ছিল তা-ই। খাটতে যারা অক্ষম, তাদেরকেও দিতে বাধ্য হয়েছে খাদ্য, মাথা গোঁজার ঠাঁই আর চিকিৎসা। বিনিময়ে শ্রম-চুক্তি সই করে দিত অক্ষম দুঃস্থরা–সেরে উঠলে গতরে খেটে শোধ করে যেত ঋণ। সই মানে টিপসই। ফোটো তুলে নেওয়া হত সেই সইয়ের। এমনভাবে নথিভুক্ত থাকত পৃথিবীব্যাপী লেবার কোম্পানির বিশ-তিরিশ লক্ষ টিপসই, যে ঘণ্টাখানেক খুঁজলেই বার করে নেওয়া যেত সইয়ের মালিককে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারখানায় খাটতে হত এক রোজ–তার জন্যে ছিল উপযুক্ত আইনকানুন। কার্যক্ষেত্রে অবশ্য একটু বাড়তি দিত লেবার কোম্পানি। খাওয়া-থাকা ছাড়াও কয়েকটা পেনি৷ কাজে উৎসাহ পেত শ্রমিকরা। ফলে দোলনা থেকে কবরখানা পর্যন্ত ঋণী এবং গোলাম হয়ে থাকত লেবার কোম্পানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মক্কেল৷
বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করা হয়েছিল এই ধরনের ভাবাবেগহীন কার্যকর পন্থায়। পথেঘাটে না খেয়ে কেউ আর মারা যেত না। ভিক্ষুক শ্রেণির বিলোপ ঘটেছিল। লেবার কোম্পানির স্বাস্থ্যকর নীল ক্যাম্বিসের কোর্তার মতো পোশাকও দুনিয়ায় আর কেউ দিতে পারেনি। দেখতে আহামরি না হলেও স্বাস্থ্য, খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসার প্রতীক হয়ে উঠেছিল এই নীল কোর্তা। ফোনোগ্রাফিক নিউজপেপারগুলোয় অষ্টপ্রহর ঢাক পেটানো হত তা-ই নিয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মতো পথেঘাটে এখন গাড়িচাপা পড়ে বা না খেয়ে কেউ মরে পড়ে থাকে না।
ওয়েটিং রুমে বসে রইল ডেনটন আর এলিজাবেথিটা ডাক আসার প্রতীক্ষায়। প্রতীক্ষারত বেশির ভাগ কর্মপ্রার্থীই গুম মেরে রয়েছে–দু-চারজন তরুণ ছাড়া। এরা জন্মেছে লেবার কোম্পানির ক্রেশ-এ, মারাও যাবে লেবার কোম্পানির হাসপাতালে, আমৃত্যু দাসখত-লেখা শ্রমিক। বাড়তি কয়েকটা শিলিং হাতে পেয়ে ওড়ায় ঝকমকে পোশাকের পেছনে। মুখে যেন খই ফুটছে। দেমাকে ফেটে মরছে।
ঝিমিয়ে রয়েছে যারা, তাদের ওপরেই এলিজাবেথিটার চোখ পড়ল সবার আগে। এদের মধ্যে রয়েছে এক বৃদ্ধা। চোখের জলে ধুয়ে যেতে বসেছে মুখের রং। ছিন্ন মলিন পোশাক, চোখে খিদের জ্বালা। একজন পাদরিও এসেছে কাজের খোঁজে। ধর্ম নিয়ে ব্যাবসা এখন তুঙ্গে পৌঁছেছে বলেই কারবারে মন্দা যায় ভাগ্যহীনদের ক্ষেত্রে। বিশপমশায়েরও কপাল যে পুড়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে ঘোলাটে চোখ দেখে।
অচিরেই ডেনটন এলিজাবেথিটার ইন্টারভিউ-পর্ব সাঙ্গ হল মহিলা ম্যানেজারের সঙ্গে। দৃপ্তমুখ রুক্ষকণ্ঠ স্ত্রীলোকটির হাবভাবে কথাবার্তায় অপরিসীম তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা। টিপসই নিয়ে নীল কোর্তা পরে সাদামাটা কিন্তু বিশাল খাবার ঘরে পৌঁছাল দুজনে। কদমছাঁট চুল কাটার দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেয়ে গেল নেহাত কপালজোরেই। লেবার কোম্পানিতে বেগার খাটতে এলেই কী নারী, কী পুরুষ–লম্বা চুল কেটে ফেলতে হয় প্রত্যেককেই। জীবনের প্রথম মেহনতি খানা খেয়ে কটুভাষিণী এই ম্যানেজারনির কাছেই ফিরে আসতে হবে কাজের নির্দেশ নিতে।
নীল কোর্তা পরার সময়ে ডেনটনের দিকে ফিরে তাকাতে পারেনি ম্রিয়মাণ এলিজাবেথিটা। তাকিয়ে ছিল কিন্তু ডেটন এবং অবাক হয়ে চেয়ে ছিল পলকহীন চোখে। নীল ক্যাম্বিসের পোশাকেও এত সুন্দরী এলিজাবেথিটা! তারপরেই রেললাইনের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এসে ঝোলের বাটি ঝাঁকুনি খেয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে যাওয়ায় চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল ডেনটন–স্রেফ খিদের জ্বালায়! তিন-তিনটে দিন পেটে দানাপানিও যে পড়েনি।
খেয়েদেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে বিরসবদনে গুটিগুটি এসে দাঁড়িয়েছিল ম্যানেজারনির সামনে। খাওয়ার সময়ে এবং জিরেন নেওয়ার সময়ে কেউ কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারেনি। কথার উৎস যেন শুকিয়ে গেছে।
দাবড়ানি দিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিয়েছিল দুমুখ ম্যানেজারনি। এলিজাবেথিটা একদিন ধাতু পেটাইয়ের কাজ শিখুক–চার পেন্স বোনাস পাবে। ডেনটনকে কাজ শিখতে হবে ফোটো কোম্পানিতে–বোনাস তিন পেন্স।
ডেনটনের ভাগ্যে জুটল কিন্তু অন্য কাজ। অত্যন্ত জটিল ধরনের জলের চাপে চলা মেশিন চালানোর কাজ। মাথা খাটানোর ব্যাপার আছে বলে ভালোই লাগল ডেনটনের। শহরের সমস্ত নোংরা জল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চারশো ফুট উঁচু চৌবাচ্চায় চালান হয় এ যুগে। সারি সারি পাম্প জল ঠেলে তুলে দেয় ওপরে। তারপর নানান পাইপের মধ্যে দিয়ে নেমে এসে ছড়িয়ে পড়ে লন্ডন শহরের চারদিকের খেতখামারে সার হিসেবে। নোংরা জল আর আবর্জনা সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার যুগ আর নেই–জল-দূষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে বিশ্ববাসী। ডেনটন যে মেশিন চালাবে, তা এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডেরই অংশ। মেশিন অবশ্য চলবে নিজেই –মেশিনের দাস হয়ে থাকতে হবে তাকে অন্যমনস্ক হবার জো নেই।