যেসব আবিষ্কার পৃথিবীর চেহারা পালটে দিয়েছে, তাদের ফিরিস্তিতে সবার আগে রয়েছে পরিবহণব্যবস্থা। যেমন রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি এবং পেটেন্ট রাস্তা। তারপর পরিবর্তনের ঢেউ এল মেহনতি মানুষদের কাজের ধারায়। চাষবাস ছেড়ে কলকারখানায় যোগ দিয়ে ভিড় করল শহরে। সেই সঙ্গে এল নানা রকমের দুর্ভোগ–ঊনবিংশ শতাব্দীতে যা কল্পনাও করা যায়নি। লোভী হয়ে উঠল মানুষ। গ্রামজীবনের উদারতা মিলিয়ে গিয়ে এল নিষ্ঠুর অর্থগুতা। জুয়ো খেলা, বিলাসিতা এবং অত্যাচারী মনোভাবে ছেয়ে গেল শহরের মানুষের মন। রোগের ডিপো হয়ে উঠল প্রতিটা শহর বেশি লোকের ভিড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে।
তিন শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গিয়েছিল নতুন সমাজের মানুষ। সবার ওপরে ধনিক সম্প্রদায়। সবার নিচে শ্রমজীবী সম্প্রদায়। এই দুইয়ের মাঝে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়।
মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের দুটি মানুষের ভালোবাসা, বিয়ে এবং পল্লি অঞ্চলে সাদাসিধে জীবনযাপন করতে গিয়ে অশেষ দুর্ভোগের কাহিনি বলা হয়েছে আগের অধ্যায়ে। গ্রাম ছেড়ে শহরে পালিয়ে এসে বাবার কাছে গচ্ছিত মায়ের শেয়ারের কাগজের ভিত্তিতে দেদার টাকা ধার করতে আরম্ভ করেছিল এলিজাবেথিটা। ডেনটন তখনও কপর্দকহীন।
চড়া সুদ দিতে হয়েছিল সে জন্যে। কিন্তু নতুন বিয়ের রঙিন মোহে তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি দুজনের কেউই। ঘরদোর সাজিয়েছিল নিজেদের বিচিত্র রুচি অনুযায়ী। খুঁজেপেতে জোগাড় করেছিল সেকালের ছাপা বই, ভিক্টোরীয় আমলের অদ্ভুত আসবাবপত্র। মিতব্যয়ী থাকার চেষ্টা করেছে গোড়া থেকেই। একটি কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সামাজিক রীতি অনুযায়ী শিশুপালন সংস্থায় না পাঠিয়ে রেখে দিয়েছে নিজেদের কাছে–সে জন্যে বাড়ি ভাড়া একটু বেশি লাগলেও ভ্রূক্ষেপ করেনি।
এইভাবেই কেটে গেল তিনটে বছর। একুশ বছরে পা দিল এলিজাবেথিটা। শেয়ারের কাগজপত্র বউয়ের নামে হস্তান্তর করার কথা বলতে শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মুখ চুন করে ফিরে এল ডেনটন।
দুঃসংবাদটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল এলিজাবেথিটার। শেয়ারের দাম পড়ে গেছে। চড়া সুদে টাকা ধার করেও ফেঁসেছে দুজনে। শ্বশুরমশায় আবার বিয়ে করতে যাচ্ছে। হাতে রয়েছে আর মোটে এক হাজার সুবর্ণ লায়ন।
সুতরাং কাজের খোঁজে বেরতে হবে ডেনটনকে। বিপদ তো সেখানেও। উড়ুক্কু যন্ত্রযানের মঞ্চে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। এলিজাবেথিটাকে বিয়ে করতে চেয়ে ব্যর্থমনোরখ বিনডন এখন সেখানকার হর্তাকর্তাবিধাতা। কিন্তু লন্ডনের তিন কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষের কেউ-না-কেউ নিশ্চয় কাজ দেবে ডেনটনকে।
কিন্তু শহর চষে ফেলেও কাজ পেল না ডেনটন। শেষে এমন অবস্থা এল যে, ওপরতলার দামি ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে নেমে আসতে হল দশ-বারোতলা নিচেকার সস্তা ফ্লাটে। এতদিন ধরে জোগাড়-করা মান্ধাতার আমলের শখের জিনিসপত্রও বেচে দিতে হল বুক ফেটে যাওয়া সত্ত্বেও। শেয়ার মার্কেটে ভাগ্যপরীক্ষা করতে গিয়ে হাজার লায়ন থেকে তিনশো লায়ন খুইয়ে একদিন বাড়ি ফিরল ডেনটন বিপর্যস্ত অবস্থায়। সাত-সাতটা দিন গুম হয়ে কাটাল ফ্ল্যাটের মধ্যে কেঁদেকেটে একসা করল এলিজাবেথিটা। তারপর আবার চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়ল ডেনটন। পেয়েও গেল একটা কাজ। সেলসম্যানের কাজ। চেহারাটা তো ভালো। মেয়েদের টুপি বিক্রি করার দোকানে তাই নামমাত্র মাইনের কাজখানা পেয়ে বর্তে গেল ডেনটন। এতদিন অবশ্য অনেক জায়গায় বড় কাজই খুঁজেছে– কিন্তু মাকাল ফলকে কে দেবে মোটা মাইনের বড় চাকরি?
কিন্তু চাকরি গেল দেড় মাস পরেই–অযোগ্যতার জন্যে। নতুন চাকরির খোঁজে বেরতে হল বেকার ডেনটনকে। কিন্তু তহবিল তদ্দিনে প্রায় শূন্য। মেয়েকে বাধ্য হয়ে দিয়ে আসতে হল শিশুপালন সংস্থায়, ইচ্ছা না থাকলেও। এ যুগের সবাই তা-ই করে। ধনী সম্প্রদায়ের বাচ্চাদের ভার নেয় সস্তার সংস্থারা। লেবার কোম্পানি শ্রমিক-কর্মচারী জুটিয়ে নেয় এখান থেকেই-বাচ্চারা বড় হয়ে যাবে কোথায়? মানুষ হওয়ার দেনা শোধ করতে হয় বেগার খেটে–আমৃত্যু।
হপ্তা তিনেক পরে ফ্ল্যাটের ভাড়া বাকি পড়তেই ঘাড়ধাক্কা খেতে হল দুজনকে। জিনিসপত্র কেড়ে নিল হোটেলের মালিক। দারোয়ানের কাছে লেবার কোম্পানির ঠিকানা জেনে নিয়ে বদ্ধপরিকর ডেনটন রওনা হল কুলির কাজেরই খোঁজে এলিজাবেথিটার হাত ধরে।
কিন্তু শিউরে উঠল নারকীয় সেই দৃশ্য দেখে। লন্ডনের রিজেন্ট স্ট্রিটের নাম পালটে হয়েছে নাইনটিন্থ ওয়ে। আটশো ফুট চওড়া। ধাপে ধাপে চলমান মঞ্চ কিনারা থেকে নেমে গেছে মাঝের দিকে। ঘন্টায় পাঁচ মাইল হারে গতিবেগ কমেছে প্রতিটি মঞ্চের। কাজেই ওপরতলার দ্রুতগামী মঞ্চ থেকে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া যায় নিচের তলায়, মানে একদম মাঝের স্থির পথে। সিঁড়ি বেয়ে নামলেই দুপাশে সারি সারি নিচুতলার বাড়ি, কলকারখানা, বড় বড় আলোক-বিজ্ঞাপন, ফোনোগ্রাফে বিজ্ঞাপনী চিৎকার, কিনেমাটোগ্রাফে বিজ্ঞাপনী বাহার, ক্লাউনের বেশে হতশ্রী নারী এবং পুরুষদের সাজিয়েও বিজ্ঞাপনের বীভৎস কারবার।
দেখেই গা হিম হয়ে গেল এলিজাবেথিটার। মুখ সাদা হয়ে গেল ডেনটনের। তার জন্যেই আজ এলিজাবেথিটার এই দুরবস্থা। এর চাইতে যে বিয়ে না-হওয়াই ছিল ভালো।