যাওয়ার আগে মেষপালকের ঠিকানা নিয়ে নিল ডেনটন। দরকারমতো খাবারদাবার, জিনিসপত্র কিনে এনে দিতে হবে শহর থেকে।
সন্ধে নাগাদ পরিত্যক্ত গ্রামটায় পৌঁছাল দুজনে। অবাক হল খুদে খুদে অদ্ভুতদর্শন বাড়ি দেখে। সূর্য তখন পাটে বসেছে। সোনা-রোদে নিঝুম হয়ে রয়েছে পুরো তল্লাটটা। খুঁজেপেতে বার করল একটা দেওয়ালহীন বাড়ির এমন একখানা কামরা, যার একধারে ফুটে রয়েছে নীল রঙের একটা বুনো ফুল–চোখ এড়িয়ে গেছে ফুড কোম্পানির ঝোঁপ সাফাই লোকজনদের।
মনের মতো এহেন আস্তানায় কিন্তু বেশিক্ষণ মন টেকেনি দুজনের কারওই। এসেছে প্রকৃতির আলয়ে প্রাকৃতিক শোভা দেখবে বলে। ঘরের মধ্যে বসে থাকা কি যায়? তাই কিছুক্ষণ পরেই রওনা হয়েছিল পাহাড়ের ওপর। অন্ধকার তখন জমিয়ে বসেছে। ঘরে থাকতেও অসুবিধে। পাহাড়ে উঠে দুচোখ ভরে দেখেছিল আকাশের লক্ষ মানিক, হৃদয় ভরে পান করেছিল নিথর নৈঃশব্দ্য। সেকালের কবিরা কত কবিতাই না রচনা করেছে স্বর্গলোকের এই সুষমা নিয়ে। পাহাড় থেকে নামল সারারাত কাটিয়ে ভোরের আলো ফোঁটার সময়ে। ঘুম হল স্বল্পক্ষণ। ছোট্ট একটা পাখির গানে চোখ রগড়ে উঠে বসল দুজনে।
দিন তিনেক এইভাবেই কাটল যেন রোমান্টিক স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে। এত সুখ, এত স্বাধীনতা কখনও পায়নি দ্বাবিংশ শতাব্দীর এই দুটি শহরে ছেলেমেয়ে। কিন্তু উত্তেজনা থিতিয়ে এল এক সপ্তাহ পরে–আরও একটা হপ্তা যাওয়ার পরে ঝিমিয়ে পড়ল একেবারেই। প্রথম প্রথম ঘরকন্নায় উঠে-পড়ে লেগেছিল। এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে ভাঙা এবং বদখত চেহারার সেকেলে চেয়ার-টেবিল এনে সাজিয়েছিল নিজেদের ভাঙা ঘর। বিছানার গদির জন্যে ভেড়াদের একরাশ ঘাস দুহাত ভরে নিয়ে এসেছিল ডেনটন। অখণ্ড অবসরে হাঁপিয়ে ওঠার পর একদিন কোত্থেকে একটা মরচে-পড়া কোদাল কুড়িয়ে নিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে মাটি কুপিয়ে ঘেমে-নেয়ে এসে এলিজাবেথিটাকে বলেছিল–সেকালের লোকগুলো অসুর ছিল নাকি? কিন্তু কাঁহাতক এইভাবে একঘেয়েমি কাটিয়ে নতুন নতুন বৈচিত্র আনা যায় এবং একই সুখের কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা এবং শোনা যায়? চেষ্টার অবশ্য ত্রুটি করেনি ডেনটন। হপ্তা দুয়েক আবহাওয়া ভালো থাকায় তেমন দুর্ভোগও পোহাতে হয়নি। শহর থেকে এতটা পথ হেঁটে আসায় গা-গতরের ব্যথা মরেনি যদিও–বরং বেড়েছে ভাঙা ঘরের খোলা হাওয়ায় রাতের পর রাত কাটিয়ে। শহরের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে মানুষ হয়ে ইস্তক মুক্ত জীবনের এহেন চেহারা তো কখনও তারা দেখেনি। তারপরেই একদিন আকাশ কালো করে ঘনিয়ে এল বৃষ্টির মেঘ। লকলকিয়ে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত। শিউরে উঠেছিল দুজনেই। বিদ্যুতের এ ধরনের ভয়ংকর রূপ কখনও তারা দেখেনি। দৌড়াতে দৌড়াতে নেমে এসেছিল ভাঙা আস্তানায়। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে মুষলধারে বৃষ্টি। ফুটোফাটা ছাদ আর ভাঙা দেওয়াল দিয়ে স্রোতের মতো জলের ধারায় সারারাত ধরে ভিজেছে দুজনে, শীতে কেঁপেছে ঠকঠক করে। ভোররাতে মেঘগর্জন যখন মিলিয়ে গেল দূর হতে দূরে, থেমে গেল বৃষ্টি–শোনা গিয়েছিল নতুন একটা শব্দ।
কুকুরের ডাক। একপাল কুকুর ধেয়ে আসছে এদিকেই। মেষপালকদের কুকুর। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঢুকে পড়েছিল ভাঙা ঘরে। কুকুর কখনও দেখেনি এলিজাবেথিটা। বিশেষ করে এই ধরনের ভয়ংকর সারমেয়। এতক্ষণ কাঁদছিল সারারাত দুর্ভোগ আর ধকলের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায়। এখন শুরু হল প্রাণ নিয়ে টানাটানি। দাঁত খিঁচিয়ে একটা কুকুর তেড়ে আসতেই তরবারি নিয়ে তাড়া করে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল ডেনটন। ছটা কুকুর ঘিরে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার ওপর। টুটিটুকুতে তখনও কামড় বসেনি–কিন্তু আর দেরিও নেই। জানলা থেকে সেই দৃশ্য দেখে আঠারো বছরের মার্জিত শিক্ষাদীক্ষা সমস্ত ভুলে গিয়ে এক লাফে দ্বাবিংশ শতাব্দী থেকে প্রথম শতাব্দীর আদিম মানবী হয়ে গিয়েছিল এলিজাবেথিটা। মরচে-পড়া কোদালটা কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে এলোপাথাড়ি হাঁকিয়ে খুলি চুরমার করেছিল কয়েকটা কুকুরের–ডেনটনের ধারালো তলোয়ারের কোপে প্রাণ গিয়েছিল আরও কয়েকটার। বাকি কটা প্রাণ নিয়ে লেজ গুটিয়ে দৌড়েছিল মনিবদের কাছে।
কিন্তু এদের মনিব তো ফুড কোম্পানি। এবার তো তারা আসবে–অনধিকার প্রবেশের সাজাও পেতে হবে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল এলিজাবেথিটা। ঢের হয়েছে–রোমান্স গল্পেই মানায়–ধাতে সয় না। এ জীবন তাদের নয়–শহরের জীবনই ভালো।
ডেনটন নিজে থেকেই বলেছিল, শহরেই ফিরে যাওয়া যাক। ফুড কোম্পানির লোকজন এসে পড়ার আগেই। পয়সা? মুখ ফুটে এতদিন বলতে পারেনি বুদ্ধিটা এলিজাবেথিটার মাথাতেই আসা উচিত ছিল। বিপুল ভূসম্পত্তির মালিক হতে যাচ্ছে যে আর তিনটে বছর পরে, সে তো অনায়াসেই ধার করতে পারে এখন থেকেই।
আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল এলিজাবেথিটা। সত্যিই তো, এ বুদ্ধি তো তার মাথায় আগে আসেনি। শহরে থাকতে গেলে দেদার টাকা দরকার–ধার করলেই তো তা পাওয়া যায়! কে না জানে তার মায়ের কুবের সম্পদের কাহিনি!
ঝটপট কিছু খাবার ব্যাগে ভরে নিয়ে দুজনে পালিয়েছিল রোমান্স-পর্বে ইতি ঘটিয়ে দিয়ে–নীল ফুলটাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অধিকার হারিয়েছিল বলে পাপড়ির গায়ে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে গিয়েছিল এলিজাবেথিটা। এস্তে পলায়ন করেছিল বিশাল সেই শহরের দিকে, যে শহর গিলে বসে আছে মানুষ জাতটাকে।
৩. শহরের জীবন
৩। শহরের জীবন