নিঃশব্দে চলেছে প্রেমিকযুগলও সড়কের কিনারা বরাবর। নতুন বর-বউ তো, তাই লজ্জা ঘিরে রয়েছে দুজনকেই। শকটারোহীরা গগনবিদারী চিৎকার ছেড়ে যাচ্ছে দুই পথচারীকে উদ্দেশ্য করে–কেন-না ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ইংলিশ সড়কে মোটরগাড়ি যেমন একটা বিরল দৃশ্য, ২১০০ খ্রিস্টাব্দে পায়ে হেঁটে যাওয়াটাও সমান বিরল দৃশ্য। ওদের কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই কোনওদিকে। স্থির চাহনি নিবদ্ধ সামনের পল্লি প্রকৃতির দিকে–কানে তুলছে না কোনও চিৎকারই।
সামনেই ঢালু হয়ে উঠে গেছে জমি–প্রথমে নীলাভ, তারপর সবুজে সবুজ। দানবাকার হাওয়াকলের চাকার পর চাকা দেখা যাচ্ছে দূরের বাড়ির ছাদে ছাদে। ভোরের টানা লম্বা ছায়ায় গা মিলিয়ে ছুটে চলেছে ভ্যানগাড়িগুলো। দুপুর নাগাদ দেখা গেল, ধূসর বিন্দুর মতো চরে বেড়াচ্ছে ফুড কোম্পানির মাংস বিভাগের ভেড়ার পাল। আরও ঘণ্টাখানেক হাঁটবার পর পেরিয়ে এল কাদামাটি, ফসল-কাটা শেকড়সর্বস্ব খেতের মাঠ এবং কাঁটাঝোপের একটিমাত্র বেড়া। বাস, বিনা অনুমতিতে প্রবেশের ভয় আর রইল না। রাস্তা ছেড়ে সবুজ মাঠে নেমে এখন নির্বিঘ্নে রওনা হওয়া যাবে পাহাড়তলি অঞ্চলে।
পাণ্ডববর্জিত এহেন অঞ্চলে এই প্রথম ওদের আগমন।
খিদেয় পেট চুঁইছুঁই করছে দুজনেরই। ফোঁসকা পড়েছে পায়ে। হাঁটাটাও তো একটা ব্যায়াম–এ ব্যায়ামের সুযোগ তো ঘটে না যন্ত্রযুগের এই সভ্যতায়। ক্ষণকাল পরেই তাই দুজনে বসে পড়ে ঝোঁপঝাড়হীন ঘোট-করে-কাটা ঘাসজমির ওপর। এবং সেই প্রথম তাকায় পেছনে ফেলে-আসা শহরের দিকে। টেমস নদীর অববাহিকায় নীলাভ কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা যায় দূরবিস্তৃত লন্ডন। ভেড়াদের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ কখনও ঘটেনি। এলিজাবেথিটার। প্রথমে একটি সন্ত্রস্তই ছিল। ভয় কেটে গেল ডেনটনের আশ্বাস বচনে। মাথার ওপর সুনীল গগনে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে একটা সাদা-ডানা বিহঙ্গ। আহার-পর্ব সমাপ্ত না-হওয়া পর্যন্ত কথা সরল না কারওই মুখে। তারপর অর্গলমুক্ত হল জিহ্বা। কলকল করে কত কথাই না বলে গেল ডেনটন। এখন থেকে সুখের সাগরে নিমজ্জিত থাকবে দুজনায়। আরও আগে বেরিয়ে আসা উচিত ছিল সোনার খাঁচার সুখাবহ বন্দিদশা থেকে। অতীতের রোমান্স মধুর দিনগুলিতে দুদিন আগে ফিরে এলে খামকা এত দুর্ভোগ তো পোহাতে হত না। বলতে বলতে ঘাসজমির ওপর রাখা তরবারি তুলে নিয়েছিল ডেনটন। শানিত ফলার ওপর কম্পিত আঙুল বুলিয়ে নিয়ে এলিজাবেথিটা জানতে চেয়েছিল–বরবাদ এই হাতিয়ার হেনে শত্রু কুপোকাত করতে পারবে তো ডেনটন? প্রয়োজন হলে তা-ই করতে হবে বইকী–বলেছিল ডেনটন। কিন্তু রক্তপাত তো ঘটবে– শিউরে উঠেছিল এলিজাবেথিটা।
একটু জিরিয়ে নিয়ে দুজনে রওনা হয়েছিল পাহাড় অভিমুখে। পথে পড়ল একপাল ভেড়া। ভেড়া কখনও দেখেনি এলিজাবেথিটা। নিরীহ এই প্রাণীগুলিকে হত্যা করা হয়। উদরপূর্তির জন্যে–ভাবতেই কাঁটা দিয়ে ওঠে গায়ে। দূরে শোনা যায় ভেড়া-সামলানো কুকুরের ডাক। হাওয়াকলের খুঁটির পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসে একজন মেষপালক। হেঁকে জানতে চায়, যাওয়া হচ্ছে কোথায়।
আমতা আমতা করে ডেনটন জানায়, যাওয়া হচ্ছে একটা নিরালা বাড়ির খোঁজে দুজনে থাকবে সেখানে। যেন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মেষপালক কিন্তু চেয়ে থাকে চোখ বড় বড় করে। বিশ্বাস হয়নি কথাটা।
নিশ্চয় কোনও কুকর্ম করে এসেছ?
এক্কেবারেই না। শহরে থাকার আর ইচ্ছে নেই–তাই এসেছি, ঝটিতি জবাব দেয় ডেনটন।
আরও অবিশ্বাস প্রকটিত হয় মেষপালকের দুই চোখে–কিন্তু এখানে তো থাকতে পারবে না।
দেখাই যাক-না চেষ্টা করে।
পর্যায়ক্রমে দুজনের মুখে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে মেষপালক, কালই ফিরে যেয়ে শহরে। দিব্যি গেলে বল তো বাপু, কী কুকর্মটি করে এসেছ? পুলিশ কিন্তু আমাদের ভালো চোখে দেখে না।
চোখে চোখ রেখে বলে ডেনটন, শহরে থাকতে গেলে পয়সা দরকার–আমাদের তা নেই। নীল ক্যাম্বিস পরে কুলিগিরি করাও আমাদের ধাতে সইবে না। চাই সাদাসিধেভাবে থাকতে–সেকেলে মানুষদের মতো।
মেষপালক যে চিন্তাশীল মানুষ, তা মুখ দেখলেই বোঝা যায়। গাল ভরতি দাড়ি। এলিজাবেথিটার নরম ধাঁচের আকৃতির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে শুধু বললে, তাদের মনেও তো ঘোরপ্যাঁচ ছিল না।
আমাদেরও নেই।
হাসল মেষপালক। বলে দিলে বহু দূরের এক পরিত্যক্ত গ্রামের নিশানা। আগে যে লোকালয়ের নাম ছিল এপসম, এখন সেখানে মাটির টিপি–ইটগুলো পর্যন্ত লোপাট করে নিয়ে গিয়ে ভেড়ার খোঁয়াড় তৈরি হয়েছে। এই টিপির পাশ দিয়ে গেলে পড়বে আর-একটা মাটির ঢিপি–অতীতে সেখানে ছিল লেদারহেড লোকালয়। পাহাড়ের পাশ দিয়ে, উপত্যকা পেরিয়ে, বিচবৃক্ষের জঙ্গলের কিনারা বরাবর গেলে পাওয়া যাবে বুনো ঝোঁপ ভরতি একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এখানকার হাওয়াকলের তলা দিয়ে পাথর দিয়ে বাঁধানো দুহাজার বছরের পুরানো একটা রোমান গলি গেছে নদীর পাড় বরাবর। সেইখানে মিলবে বেশ কিছু বাড়ি। কয়েকটার ছাদ এখনও ভেঙে পড়েনি। মাথা গোঁজার ঠাইটুকু অন্তত পাওয়া যাবে। খুবই শান্ত, খুবই নিরিবিলি জায়গা। কিন্তু রাত ঘনিয়ে এলে জ্বলে না কোনও আলো–ডাকাতরাও নাকি টহল দেয়–অবশ্য শোনা কথা। গল্পকথকদের ফোনোগ্রাফি, প্রমোদ ব্যবসায়ীদের কিনেমাটোগ্রাফ নেই একেবারেই। খিদে পেলে পাওয়া যাবে না খাবার, অসুখ হলে ডাক্তার।