ডুকরে কেঁদে উঠেছিল এলিজাবেথিটা। তিন-তিনটে বছর–দীর্ঘ ছত্রিশটা মাস এইভাবেই কি কষ্ট করে কাটাতে হবে?
আচম্বিতে একটা বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল ডেনটনের মগজে। গ্রামে গেলে কেমন হয়?
দারুণ অ্যাডভেঞ্চার সন্দেহ নেই। কিন্তু সিরিয়াসলি তা-ই কি চায় ডেনটন? ডাগর চোখ তুলে চেয়েছিল এলিজাবেথিটা। থাকা হবে কোথায়?
কেন, ওই পাহাড়ের ওপারে বিস্তর বাড়িঘরদোর তো এখনও আছে। এককালে মানুষ থাকত সেখানে। এখনই বা অসম্ভব হবে কেন? ডেনটন বুঝিয়েছিল এলিজাবেথিটাকে।
বলেছিল, গ্রাম আর শহরের ধংসাবশেষ তো ফ্লায়িং মেশিন থেকেই দেখা যায়। পড়েই আছে–মাটিতে মিশিয়ে দিতে গেলেও তো খরচ হবে–ফুড কোম্পানি সে খরচ করতে রাজি নয়। গোরু, মোষ, ভেড়া চরবার জায়গা এখন। রাখালদের কাউকে পয়সা দিলেই খাবার এনে দেবে। একখানা বাড়ি নিজেরাই মেরামত করে নিয়ে দিব্যি থাকা যাবে।
উঠে দাঁড়িয়েছিল এলিজাবেথিটা। প্রদীপ্ত চোখ। দারুণ প্রস্তাব নিঃসন্দেহে। কিন্তু পলাতক আসামিদের ডিপো যে ওখানে… যত চোর-ডাকাতদের আস্তানা…।
ছেলেমানুষের মতো ডেনটন তখন বলেছিল, তাতে কী! একটা তলোয়ার জুটিয়ে নিলেই হল!
বিষম উৎসাহে চোখ জ্বলে উঠেছিল এলিজাবেথিটার। তলোয়ার জিনিসটা সম্পর্কে আগেই অনেক কথা সে শুনেছে, মিউজিয়ামে দেখেওছে। রোমান্স আর অ্যাডভেঞ্চার সৃষ্টি করেছে ইস্পাতের এই হাতিয়ার অতীতকালে–সব বীরপুরুষই সঙ্গে রাখত। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাই জানতে চায় আরও বৃত্তান্ত। যতই শোনে, ততই উৎসাহ আর উত্তেজনার মাদল বাজনা বাজতে থাকে অণু-পরমাণুতে। খাবারদাবার? দিন দশ-বারোর খাবার সঙ্গে নিলেই হল। ওটা কোনও সমস্যাই নয়। কেননা, এ যুগের খাবারমাত্রই কৃত্রিম পুষ্টিজমিয়ে শক্ত করে এতটুকু সাইজে নিয়ে আসা। দশ-বারো দিনের খাবার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া এমন কী ব্যাপার? বাড়ি মেরামত না-হওয়া পর্যন্ত ছাদহীন ঘরগুলোয় আকাশ চন্দ্রাতপের তলায় শুয়ে থাকলেই হল। এখন গরমকাল। লন্ডন বাসিন্দারা শিল্পীর হাতে ছবি আঁকা, বাহারি আলোয় ঝলমলে ছাদওয়ালা ঘরে থাকতে থাকতে ভুলেই গেছে, তার চাইতেও ভালো কড়িকাঠ নিয়ে বসে আছেন স্বয়ং প্রকৃতিদেবী তাঁর লীলানিকেতনে। ওই আকাশে লক্ষ-কোটি নক্ষত্রর ঝিকিমিকি… অমন কড়িকাঠের তলায় ঘুমানোর মতো মজা কি আর হয়?
ডেনটনের আবেগময় ভাষা পাগল করে দিয়েছিল এলিজাবেথিটাকে। প্রথমে একটু দ্বিধা ছিল ঠিকই। এক হপ্তা পরে তা ফিকে হয়ে এল, একেবারেই মিলিয়ে গেল আরও একটা সপ্তাহ পরে। শহরের বন্দিদশা থেকে পরিত্রাণের এমন মতলব আগে কেন মাথায় আসেনি, ভেবে আক্ষেপের অন্ত রইল না দুজনেরই। মুক্তি। মুক্তি! উদার আকাশের তলায় প্রাচীন ও পরিত্যক্ত পল্লি এবং নগরীর মধ্যে অনাবিল স্বাধীনতার আনন্দ-কল্পনায় মশগুল হয়ে রইল দুজনে।
তারপর একদিন গ্রীষ্মের মাঝামাঝি একটি প্রত্যূষে দেখা গেল, উড়ুক্কু যন্ত্রযানের মঞ্চে ডেনটনের জায়গায় কর্তব্যনিরত রয়েছে আর-একজন সামান্য কর্মচারী।
গোপনে বিয়েটা সেরে নিয়েছে ডেনটন আর এলিজাবেথিটা। পূর্বপুরুষদের মতোই মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে রওনা হয়েছে পল্লি প্রকৃতির শ্যামলিমার সন্ধানে। এলিজাবেথিটার পরনে আগেকার আমলের সাদা বিয়ের পোশাক। ডেনটন পরেছে বেগুনি রঙের ঢোলা বেশ–পিঠে চামড়ার ফিতেয় বাঁধা খাবারদাবার–কোমরে আলখাল্লার তলায় স্টিলের তরবারি। শেষোক্ত বস্তুটা বহন করছে লাজরক্তিম মুখে।
কল্পনা করুন তো দেখি ওদের পাড়াগাঁ অভিমুখে যাওয়ার ছবিটা! ভিক্টোরীয় আমলের দিগন্তবিস্তৃত শহরতলি আর জঘন্য পথঘাট কোথায়? পুঁচকে বাড়ি, নির্বোধপ্রতিম খুদে বাগান, গোপনীয়তা রক্ষার নিষ্ফল প্রয়াস তিরোহিত হয়েছে কোনকালে। নবযুগের আকাশচুম্বী সৌধশ্রেণি, যান্ত্রিক পথঘাট, বিদ্যুৎ এবং জল সরবরাহ ব্যবস্থা–সবই আচম্বিতে শেষ হয়েছে চারশো ফুট উঁচু পর্বত প্রাচীরের মতো খাড়াই দেওয়ালের সামনে। শহর ঘিরে রয়েছে ফুড কোম্পানির গাজর, শালগম, ওলকপির খেত। হাজার রকমের বিচিত্র খাদ্যসম্ভার প্রস্তুত হচ্ছে তো এইসব সবজি থেকেই। ঝোপঝাড়ের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছেন। কোথাও? নির্মূল হয়েছে সামান্য কাঁটাঝোঁপ আর বুনো ফুলের গাছও। প্রাচীনকালে যা ছিল পরম উৎপাত, ফুড কোম্পানি তার অবসান ঘটিয়েছে চিরতরে। বছরের পর বছর বর্বর প্রথায় ঝোঁপঝাড় গজিয়ে যেত খেতখামারে–এখন আর তা হয় না। ফলে, উৎপাদন বেড়েছে, বাজে খরচ কমেছে। মাঝে মাঝে অবিশ্যি দেখতে পাচ্ছেন আপেল এবং অন্যান্য ফলভারে অনবত বৃক্ষ। এ ছাড়াও রয়েছে বিশালকায় কৃষিযন্ত্র, জলনিরোধক ছাউনির তলায়। আয়তাকার খালের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে খেতের জল। মাঝে মাঝে উঁচু জায়গাগুলোয় আবর্জনা পচিয়ে নির্গন্ধ সার সরবরাহ করা হচ্ছে আশপাশের খেতে।
প্রকাণ্ড শহর প্রাচীরের বিশাল ধনুকাকৃতি তোরণের সামনে থেকে বেরিয়েছে এন্ডহ্যামাইট সড়ক–গেছে পোর্টসমাউথ পর্যন্ত। ভোরের সোনা-রোদে দেখা যাচ্ছে নীল কোর্তা-পরা ফুড কোম্পানির পরিচারকদের–পিলপিল করে চলেছে পথ বেয়ে সূর্য না ডোবা পর্যন্ত গতর খাটাতে। ধাবমান এই জনতার পাশে বিন্দুবৎ চলেছে ওরা দুজনে, নজরই পড়ে না সেদিকে। সড়কের দুপাশের কিনারা বরাবর গোঁ গোঁ গরগর ঘড়ঘড় শব্দে ধেয়ে যাচ্ছে মান্ধাতার আমলের বাতিল মোটরগাড়ি–শহর সীমানা থেকে বিশ মাইল চৌহদ্দি পর্যন্ত এদের ডিউটি। তার ভেতরদিককার পথ দিয়ে ছুটছে হরেকরকম যন্ত্রযান; দ্রুতগামী মনোসাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অগুনতি আরোহী, পাশে পাশে ধেয়ে যাচ্ছে। হিলহিলে চেহারার মাল্টি-সাইকেল আর বিস্তর বোঝা নিয়ে চার চাকার সাইকেল, চলেছে দানবাকৃতি মাল-বওয়া শকট–এখন শূন্য, কিন্তু সন্ধ্যা সমাগমে ফিরবে খেতের মালবোঝাই হয়ে। ইঞ্জিনের ধুকধুক শব্দ, হর্ন আর ভেঁপুর মিলিত ঐকতানে মুখরিত সড়কের ওপর দিয়ে বনবন করে ঘুরে চলেছে অগুনতি চক্র–নিঃশব্দে।