- বইয়ের নামঃ ভাবীকালের একটি গল্প
- লেখকের নামঃ এইচ জি ওয়েলস
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
ভাবীকালের একটি গল্প
১. প্রেমরোগ সারানোর দাওয়াই
ভাবীকালের একটি গল্প ( A Story of the Days to Come) – উপন্যাস – এইচ জি ওয়েলস। অনুবাদ – অদ্রীশ বর্ধন
[‘A Story of the Days to Come’ ধারাবাহিক আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৯ সালের জুন থেকে অক্টোবর মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায়। ১৮৯৯ সালে লন্ডনের ‘Doubleday & McClure Co’ থেকে প্রকাশিত ‘Tales of Space and Time’ সংকলনে উপন্যাসটি স্থান পায়। এপ্রিল ১৯২৮ সালে এটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়।]
১। প্রেমরোগ সারানোর দাওয়াই
মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমলের খাঁটি ইংরেজ মি. মরিস অতিশয় সজ্জন পুরুষ। সচ্ছল অবস্থা। টাইমস দৈনিক পড়েন রোজ। ফি-হপ্তায় গির্জায় যান। দুপায়ে যারা দাঁড়াতে পারেনি, তাদেরকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেন। নিয়মমতো চুল কাটেন। দানধ্যান করেন। জামাকাপড়ও পরিচ্ছন্ন। স্মার্ট। তৃপ্ত। সুখী। আদর্শ পুরুষ।
একটি বউ-ছেলেমেয়েও আছে। বেশি নয়, কমও নয়। সুশিক্ষা দিয়েছেন ছেলেমেয়েদের –যার যা দরকার, সবই দিয়েছেন। যা সংগত, যা ন্যায্য, মি. মরিসের জীবনে তার কোনওটিরই ঘাটতি নেই। মাঝবয়সে একদিন মারাও গেলেন ভদ্রলোক। কবরস্থ হলেন। মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত হল তাঁর জমকালো স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিফলকে উত্তীর্ণ বাড়াবাড়ি কিছু রইল না, অর্থহীনও কিছু রইল না।
এই গল্প শুরু হওয়ার অনেক আগেই ধুলো হয়ে গেল তাঁর দেহাস্থি–উড়িয়ে দেওয়া হল হাওয়ায়। শুধু তাঁর নয়, তাঁর নাতিপুতিদের হাড়ের ধুলোরও অবস্থাটা দাঁড়াল একই রকম। মি. মরিস কিন্তু কল্পনাও করতে পারেননি, এমন কাণ্ড ঘটতে পারে। জীবদ্দশায় কেউ তাঁকে এই ধরনের সম্ভাবনার কথা বললে দুঃখ পেতেন। মানুষ জাতটার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যাঁরা নির্বিকার, তিনি তাঁদেরই একজন। মি. মরিস অবশ্য আর-এক কাঠি সরেস এ ব্যাপারে। ওঁর মৃত্যুর পর মানবজাতির আদৌ কোনও ভবিষ্যৎ থাকবে কি না, এ বিষয়ে ঘোর সন্দেহ ছিল তাঁর।
কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অসহিষ্ণু মনোভাব নিয়ে মানুষ জাতটা টিকে রইল তাঁর এবং নাতিপুতিদের দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার পরেও। ভদ্রলোকের নয়নসুন্দর স্মৃতিসৌধের মার্বেল পুড়িয়ে বাড়ি তৈরির উপাদানও তৈরি হয়ে গেল। দুনিয়া এগিয়ে চলল আগের মতোই।
আর-একটা ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী শুনলে রেগে যেতেন মি. মরিস। পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া অগুনতি মানুষের রক্তে মিশে গিয়েছিল তাঁরও ধমনির রক্ত। হাজার হাজার পরদেশির রক্তে ঠাঁই নিয়েছিল তাঁর খাঁটি ইংরেজ রক্ত।
এই একই পরিণতি ঘটবে এ কাহিনি যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও। যে জীবনে তাঁরা অভ্যস্ত, দিকে দিকে ছড়িয়ে যাবে সেই জীবন–হাজারখানেক পরদেশি ছাপ পড়বে সেই জীবনে–উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে না–কল্পনাও করা যাবে না।
মি. মরিসের বংশধরদের মধ্যে ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি তাঁর পূর্বপুরুষের মতোই প্রায় সুস্থমস্তিষ্ক এবং কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন। সেইরকমই খর্বকায় বলিষ্ঠ আকৃতি। নামটিও তা-ই –তবে উচ্চারণটা অন্যরকম–মরিস হয়ে গিয়েছে স্বরেস। মুখের ভাবেও সেই একই রকম ফিকে অবজ্ঞা। অবস্থা সচ্ছল। সমকালীন তরুণ তুর্কিদের দুচক্ষে দেখতে পারেন না। মরিসের মতো ভবিষ্যৎ এবং নিম্নশ্রেণির ব্যক্তি সম্বন্ধে একই মনোভাব পোষণ করেন। টাইমস বলে যে একটা দৈনিক পত্রিকা ছিল, সে খবরও রাখেন না। মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে টাইমস। ওঁকে খবর শুনিয়ে যায় ফোনোগ্রাফ মেশিন। প্রাতঃকর্ম সারবার সময়ে বকবক করে বিশ্বের খবর বলে যায় আশ্চর্য এই যন্ত্র। আকার-আয়তনে ডাচ ঘড়ির মতো। সামনের দিকে আছে বিদ্যুৎচালিত আবহাওয়া নির্দেশক ব্যারোমিটার, বিদ্যুৎচালিত ঘড়ি আর একটা ক্যালেন্ডার। সারাদিনে কার কার সঙ্গে দেখা করতে হবে, তা মনে করিয়ে দেওয়ার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রও আছে ফোনোগ্রাফের সামনে। ঘড়ির মুখটা তুরীর মতো ফাঁদালো। খবর শুরু হলেই গাঁকগাঁক আওয়াজ বেরিয়ে আসে তূরীর চোঙা দিয়ে। উড়ুক্কু বাস সারা পৃথিবী ছেয়ে ফেলেছে বলেই দুর্ঘটনা ঘটে আকছার–রাতে কোথায় কটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটেছে, সে খবর পরিবেশন করে ফোনোগ্রাফ; তিব্বতে নতুন কী ফ্যাশনের আমদানি ঘটল, তা-ও জানা হয়ে যায়। জামাকাপড় পরার সময়ে শুনতে পান একচেটিয়া ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোথায় কী মিটিং হয়ে গেল গতকাল। খবর ভালো না লাগলে, শুধু একটা বোতাম ছুঁয়ে দেন স্বরেস। যেন দম আটকে আসে ফোনোগ্রাফের–খাবি খেতে খেতে শুরু করে অন্য খবর।
স্বরেস সাহেবের প্রাতঃকর্ম অবশ্য তাঁর পূর্বপুরুষের মতো নয় মোটেই। পুরাকালের মরিস দেখলে আহত হতেন। বুক চৌচির হয়ে যেত আদ্যিকালের মরিসের জামাকাপড়ের ছিরি দেখলে। ছি ছি ছি! স্বরেস সাহেব ন্যাংটা হয়ে দুনিয়া চরকি দিয়ে আসবেন তবুও ভালো, কিন্তু প্রাচীনকালের মরিস সাহেবের মতো সিল্কের টুপি, ফ্ৰককোট, ধূসর ট্রাউজারস আর ঘড়ির চেন গায়ে চাপিয়ে সং সাজতে রাজি নন কোনওমতেই। দাড়ি কামানোর হাঙ্গামার মধ্যেও মরতে মলেও যান না স্বরেস সাহেব। ও আদি অভ্যাস এ যুগে কি মানায়? নিপুণ কারিগর অনেকদিন আগেই গাল থেকে প্রতিটা চুলের গোড়া পর্যন্ত তুলে দিয়েছে। দাড়ি এক্কেবারে নির্মূল মৃত্যু পর্যন্ত। কামানোর ঝাটও নেই। পদযুগলকে ঢেকে রাখবার জন্যে ট্রাউজারস নামক বিদঘুটে পোশাকই বা পরতে যাবেন কেন? পরেন গোলাপি আর অম্বর রঙের এয়ার-টাইট বস্তুনির্মিত পোশাক–দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। পা দুখানা যে লিকলিকে সরু নয় রীতিমতো পেশিবহুল তা বোঝানোর কায়দাটা দারুণ অভিনব। পাম্প লাগানো আছে পোশাকের মধ্যে। বাতাস ঢুকিয়ে ট্রাউজারস ফুলিয়ে দেন। দেখলেই মনে হয় যেন থাকে থাকে মাস্ল সাজানো রয়েছে পুষ্ট পদযুগলে। কোথায় লাগে হারকিউলিসের পেশি! এর ওপর চাপানো বাতাস ভরতি ধরাচুড়া–সবার ওপর অবশ্য থাকে অম্বর সিল্কের টিউনিক–যা রোম দেশের মানুষরা পরত। ফলে, হঠাৎ প্রচণ্ড গরম বা নিদারুণ ঠান্ডায় কষ্ট পেতে হয় না। সবকিছুর ওপর পরেন টকটকে লাল রঙের একটা আলখাল্লা–কিনারাগুলো অত্যাশ্চর্যভাবে বাঁকানো। মাথার টুপিটা বাস্তবিকই অদ্ভুতদর্শন–মোরগের ঝুঁটির মতো। অদ্ভুত হলেও দেখতে ভারী সুন্দর। টকটকে লাল রং। মাথায় সেঁটে থাকে বাতাসের শোষণ-টানে। টুপি ফুলে থাকে হাইড্রোজেন গ্যাসে ভরতি থাকায়। ও হ্যাঁ, স্বরেস সাহেবের মাথায় কিন্তু চুলের বালাই নেই। নাপিত নামক চুলের কারিগর প্রতিটা কেশ সমূলে উৎপাটন করেছে বহু বছর আগে। ফলে, টুপি ঠিকরে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। রোজ সকালে এহেন পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে প্রশান্ত চোখে স্বরেস সাহেব বেরিয়ে পড়েন সমকালের মানুষদের সামনে।