অচিরেই নিঃসীম আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেল লন্ডনবাসীরাও। খবর পৌঁছেছে সেখানেও। পোকামাকড়দের মতো মানুষ মারতে মারতে বিকটদর্শন যন্ত্রদানবদের চালিয়ে নিয়ে আসছে মঙ্গলগ্রহীরা–এ খবর সেখানে পৌঁছাতেই শিউরে উঠল প্রতিটি মানুষ। এখন উপায়?
লন্ডনের গণ-আতঙ্ক কী পর্যায়ে পৌঁছেছিল, পরে তা শুনেছিলাম আমার ভাইয়ের মুখে। ও তখন লন্ডনেই ছিল। সকালের দিকে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল, খবরের কাগজ ফিরি করছে কাগজওয়ালা। আর চেঁচিয়ে যাচ্ছে তারস্বরে–বিপদ! বিপদ! দম আটকে মৃত্যু! কালো ধোঁয়া!
কাগজ নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়েই থ হয়ে গিয়েছিল আমার ভাই। প্রধান সেনাপতির হুশিয়ারি ছাপা হয়েছে বড় বড় করে–তলায় মঙ্গলগ্রহীদের ধ্বংসযজ্ঞের লোমহর্ষক ফোটোগ্রাফ।
কমান্ডার-ইন-চিফ বলেছেন, বিষ-ধোঁয়ার মেঘ ছড়িয়ে দিচ্ছে মঙ্গলগ্রহীরা। নিশ্চিহ্ন করেছে সৈন্যবাহিনীকে। এগচ্ছে লন্ডনের দিকে। পালানো ছাড়া বাঁচার পথ আর নেই!
ফলে, প্যানিক ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা লন্ডন শহরে। ষাট লক্ষ নগরবাসী একই সঙ্গে লন্ডন ছেড়ে ছুটল উত্তরদিকে। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। যত দূর চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। কাতারে কাতারে মানুষ প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে প্রাণপ্রিয় শহর ছেড়ে অন্য গ্রহ থেকে মাত্র জনাকয়েক আগন্তুক আততায়ীর ভয়ে। তাদের চোখে দেখেনি কেউই–শুধু শুনেছে বর্ণনা। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে অসামান্য কাণ্ডকারখানা শুনেই। সুতরাং দে চম্পট! দে চম্পট! দে চম্পট!
খালি হয়ে গেল লন্ডন শহর। আমার ভাই কোনওমতে পৌঁছাল নদীর ধারে। জাহাজে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। এত লোক উঠেছে এবং তখনও উঠছে যে, জাহাজটাই না ডুবে যায়। যারা উঠতে পারেনি, তাদের চেঁচামেচি-হট্টগোলে কানের পোকা বেরিয়ে যায় আর কী! ভায়া আমার এদিকে খুব চৌকস। অত ভিড়ের মধ্যেও নিজের জায়গা করে নিয়ে- ছিল জাহাজে। সঙ্গে সঙ্গে চিমনি দিয়ে গলগলিয়ে কালো ধোঁয়া ছেড়ে জাহাজ সরে এসেছিল তীর থেকে তফাতে। আর ঠিক তখনই বহু দূরে দেখা গিয়েছিল দীর্ঘ- দেহী এক যন্ত্রদানব-কে। বহু দূরে থাকায় তখনও কালো বিন্দুর মতো মনে হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু যেভাবে বাড়িঘরদোর, কার- খানা টপকে এগিয়ে আসছিল, তাতেই বোঝা গিয়েছিল তেপায়া দানব লম্বায় কতখানি।
জাহাজ থেকে বহু দূরের সেই চলমান বিভীষিকাকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল আমার ভায়ের। শোনা কথা যে এতখানি বুক-কাঁপানো সত্যি হতে পারে, হাড়ে হাড়ে তা টের পেয়েছিল। সেই প্রথম স্বচক্ষে মঙ্গলগ্রহীদের যন্ত্রদানব দেখেই নাকি ধাত ছেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল জাহাজসুদ্ধ প্রত্যেকেরই।
তেপায়া দানবের দল দেখতে দেখতে এসে পৌঁছেছিল জলের ধারে। জাহাজ ভরতি মানুষ পালাচ্ছে দেখে লম্বা লম্বা ঠ্যাং বাড়িয়ে জলেও নেমে পড়েছিল। তাড়া করেছিল পেছনে। ফুল স্পিডে জাহাজ চালাতে হুকুম দিয়েছিলেন ক্যাপটেন। থরথর করে কাঁপছিল চিমনি আর গোটা জাহাজটা পুরোদমে ইঞ্জিন চলায়। তা সত্ত্বেও মনে হয়েছিল যেন। শামুকের গতিতে যাচ্ছে জাহাজটা–অবিশ্বাস্য বেগে পেছনে তাড়া করে আসছে করাল যন্ত্রদানব!
আচমকা কাত হয়ে পড়েছিল জাহাজ। তাল সামলাতে না পেরে ঠিকরে পড়েছিল আমার ভাই। পরক্ষণেই দেখেছিল, প্রায় একশো গজ দূর দিয়ে একটা লোহার জাহাজ জল তোলপাড় করে ছুটে যাচ্ছে আগুয়ান বিভীষিকা-র দিকে।
দেখেই উল্লসিত হয়েছিল আমার ভাই। চিনতে পেরেছিল জাহাজটাকে। টর্পেডোবাহী যুদ্ধজাহাজ। সোজা তেড়ে যাচ্ছে তেপায়া দানবের দিকে।
তারপয়েই শোনা গিয়ে ছিল যেন বজ্রনির্ঘোষ। গর্জে উঠেছিল টর্পেডো কামান। তাল তাল ধোঁয়া ঠিকরে গিয়েছিল কালো জলের ওপর দিয়ে–অন্ধকারের বুক চিরে নক্ষত্রবেগে ধেয়ে গিয়েছিল সাক্ষাৎ যমদূত–বিস্ফোরকে ঠাসা টর্পেডো!
আচমকা উৎপাতকে সটান ধেয়ে আসতে দেখে যন্ত্রদানবও সজাগ হয়ে গিয়েছিল এবং রশ্মিবর্ষণ করেছিল পলকের মধ্যে।
ফলটা হল ভয়ানক। পিলে চমকে গিয়েছিল আমার ভায়ার।
লৌহনির্মিত অমন মজবুত গোটা যুদ্ধজাহাজটা ফেটে চৌচির হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত ছিটকে ছিটকে পড়ল চক্ষের নিমেষে। রশ্মিঝলকের সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল প্রচণ্ড ঝলসানিতে। সে কী ফ্ল্যাশ! যেন লক্ষ বিদ্যুৎ একযোগে আছড়ে পড়েছিল লোহার জাহাজটার ওপর।
পরের মুহূর্তেই দেখা গেল জাহাজ নিশ্চিহ্ন। পেছনে দাঁড়িয়ে কুটিল যন্ত্রদানব। যেন কিছুই হয়নি, ছেলেখেলা করে গেল এইমাত্র!
সুযোগটার সদ্ব্যবহার করেছিল ছোট্ট জাহাজের ক্যাপটেন। ফুল ফোর্সে ইঞ্জিন চালিয়ে মানুষ-ঠাসা জলযানকে নিয়ে গিয়েছিল বার-সমুদ্রের দিকে।
অন্ধকার যখন বেশ গাঢ় হয়ে এসেছিল, চিৎকার শোনা গিয়েছিল ক্যাপটেনের কণ্ঠে। আঙুল তুলে কী যেন দেখাচ্ছেন বহু দূরে।
জাহাজসুদ্ধ লোক তাকিয়েছিল সেদিকে। দেখেছিল, তারাভরা আকাশকে সবুজ আলোয় ঝলসে দিয়ে চতুর্থ সিলিন্ডার নেমে যাচ্ছে ধরিত্রীর বুক লক্ষ্য করে–পেছনে রেখে যাচ্ছে। সবুজ আলোর রেখা–প্রোজ্জ্বল এবং অশুভ।
লন্ডনে যখন এই কাণ্ড চলছে, পলায়নের হিড়িক উঠেছে, মূর্তিমান মেশিন দানব আবির্ভূত হয়ে লৌহ রণতরিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ছাড়ছে–ঠিক সেই সময়ে ক্ষিপ্তমস্তিষ্ক পাদরি সাহেবের সঙ্গে প্রাণের ভয়ে আমি লুকিয়ে আছি একটা খালি বাড়িতে। বাড়ির মালিক সবকিছু ফেলে-ছড়িয়ে পালিয়েছে প্রাণের মায়ায়–আমরা ঠাঁই নিয়েছি পরিত্যক্ত সেই গৃহে প্রাণপাখিকে পিঞ্জরে ধরে রাখার প্রয়াসে।