সব শেষ! নিমেষমধ্যে যুদ্ধ খতম। খুব যে বড়াই করেছিল সেনাধ্যক্ষ-মৃত্যু যে এমন অতর্কিতে আসতে পারে, কল্পনাও করতে পারেনি। জানি না, এই মুহূর্তে তার পিঞ্জরশূন্য নশ্বর দেহটা আস্ত অবস্থায় আছে, না টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মাঠের নানা দিকে।
কিন্তু কী আশ্চর্য! মৃত্যু নেই কি তেপায়া দানরের? ভূপাতিত যন্ত্রদানবের ভেতর থেকে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এল বিকটাকার একজন মঙ্গলগ্রহী। কদাকার সেই দেহ-কমন প্রান্তরে যা দেখে রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল আমার। সেই বীভৎস চোখ। সেই কিলবিলে শুড়। গুটিগুটি বেরিয়ে এসে যন্ত্রপাতি মেরামতি নিয়ে ব্যস্ত হল মাঠের মধ্যেই। আমরা পৃথিবীর মানুষরা ছেঁড়া কাপড় যেভাবে সেলাই করে নিই ছুঁচ দিয়ে অনায়াসে, খণ্ডবিখণ্ড যান্ত্রিক পা খানাকেও সেইরকম অতি সহজে ঠিক করে নিল বিদঘুটে মঙ্গলগ্রহী। তুখড় কারিগর বটে। যন্ত্রশিল্পে কতখানি দক্ষতা থাকলে এত সহজে এত কম সময়ে মেশিন মেরামত করা সম্ভব হয়, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
ভগ্নপদ ঠিক হয়ে যেতেই এক ঝটকান দিয়ে ফের সিধে হয়ে দাঁড়াল যন্ত্রদানব!
গুলি-বারুদ-কামান-বন্দুক ফেটে উড়ে যেতেই এবং একই সঙ্গে আশপাশের বনভূমিতে আর ঘরবাড়িতে আগুন লেগে যেতেই লোকজন পালিয়েছিল যে যেদিকে পারে। পালিয়েছিলাম আমিও। তারপর একটা ঝোপের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ক্লান্ত দেহে৷ প্রান্তর জুড়ে তখন বিরাজ করছে ধোঁয়া আর আগুন। উকট গন্ধেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি আমার–এতই ক্লান্ত হয়েছিলাম সেই রাতে।
ঘুম ভাঙার পর দেখলাম, আমার পাশে বসে একজন পাদরি। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল আমার। শুষ্ক কণ্ঠে জল চেয়েছিলাম তার কাছে। বিষমুখে ঘাড় নাড়তে নাড়তে পাদরি জানিয়েছিল, জল-টল কিছুই নেই তার কাছে। পরক্ষণেই ক্ষিপ্তের মতো হাত-পা ছুঁড়ে সে কী চিৎকার–মাথাটা সাফ করবার জন্যে পায়চারি করছিলাম মশায়–হঠাৎ এ কী কাণ্ড! আগুন, ভূমিকম্প, মৃত্যু!
হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমি। মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি পাদরি সাহেবের? দুই চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। মুখ বিকৃত হয়ে গেছে প্রচণ্ড উত্তেজনায়। ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছে আপন মনে–শেষ… শেষ… পৃথিবীর শেষ! পাপে ভরে উঠেছিল এই পৃথিবী। তাই শেষ হয়ে গেল মানুষ জাতটা।
বেশ বুঝলাম, নারকীয় কাণ্ডকারখানা স্বচক্ষে দেখে মাথাটাকে বিগড়ে বসে আছে পাদরিসাহেব। পাগল হয়ে গেছে একেবারেই বদ্ধ উন্মাদ!
অন্ধকারের মধ্যে পাগলের প্রলাপ আরও কতক্ষণ শুনতে হত জানি না, আচমকা টনক নড়ল দুরে দুটো চলমান তেপায় দানবকে দেখে।
মনে পড়ল সেই সেনাধ্যক্ষের স্বগতোক্তি। লন্ডন পর্যন্ত সর্বত্র কামান সাজানো আছে যন্ত্রদানবদের রুখে দেওয়ার জন্যে। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে অনেকটা পথ এসেছি ঠিকই, কিন্তু ঝোপেঝাড়ে নিশ্চয় ওত পেতে আছে কামান আর গোলন্দাজবাহিনী। এখনই শুরু হবে গোলাবর্ষণ। প্রচণ্ড নির্ঘোষে এখনই খানখান হয়ে যাবে রাতের নৈঃশব্দ্য। যন্ত্রদানবরা যতই শক্তিধর হোক-না কেন, অপরাজের যে নয়, তার প্রমাণ তো দেখেই এসেছি। তাক করে আঘাত হানতে পারলে ওদের ধরাশায়ী করতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু এ কী হাল! রশ্মিবর্ষণের ধার দিয়েও যে গেল না বিকট দানবরা। ভেবেছিলাম, মারণরশ্মি ঝলকে ঝলকে নিক্ষিপ্ত হবে কামানবর্ষণ শুরু হলেই। কিন্তু তার আগেই আর একটা সাংঘাতিক অস্ত্র প্রয়োগ করল মঙ্গলগ্রহীরা।
কালো ধোঁয়া!
২. দৃশ্যটা অবর্ণনীয়
দৃশ্যটা অবর্ণনীয়। লম্বা লম্বা পাইন গাছকে অবলীলাক্রমে টপকে বেরিয়ে এল তেপায়া দানবরা। পরক্ষণেই প্রত্যেকের মাথার বাক্স থেকে তীব্রবেগে ঠিকরে এল কালো ধোঁয়া। দু-চারটে কামান গর্জে উঠেছিল ঠিক সেই মুহূর্তে মানুষ-পোকাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকা- নো রয়েছে ঠিক কোন জায়গাগুলোতে, মঙ্গলগ্রহী- রা জেনে গিয়েছিল সেই কারণেই। ধোঁয়া নিক্ষেপ করলে ঠিক সেই সেই দিকে।
মারাত্মক সেই ধোঁয়া ছড়িয়ে গেল জমি ঘেঁষে। উপত্যকায় দিকে দিকে গড়িয়ে গিয়ে ঢুকে গেল প্রতিটা খাঁজে খাঁজে, ফাঁকে, ফোকরে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে বিষ-ধোঁয়া ফুস-ফুঁসে প্রবেশ করতেই মরণের কোলে ঢলে পড়ল আমাদের সেনানীরা। নিস্তব্ধ হয়ে গেল কামানগুলো। নিস্তব্ধ হয়ে গেল সমস্ত প্রান্তর। ঘন কালো ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেল চারদিক। বাড়িঘরদোর পর্যন্ত ঢেকে গেল কালো ধোঁয়ায়। ঘরের মধ্যে থেকেও রেহাই পেল না আবালবৃদ্ধবনিতা। চকিত মৃত্যু সবাইকেই নিয়ে গেল পরলোকে।
নিষ্ঠুর মৃত্যুদূতেরা দাঁড়িয়ে রইল কেবল প্রান্তরের মাঝে। চারদিক নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যেতেই, প্রাণের সমস্ত স্পন্দন চারদিকে থেমে যেতেই স্তব্ধ করল কালো ধোঁয়াবর্ষণ। পিচকিরির মতো এতক্ষণ যে ধূমপুঞ্জ তীব্রবেগে ধেয়ে যাচ্ছিল দিকে দিকে, অকস্মাৎ তা বন্ধ করে দিয়ে ধোঁয়ার ওপর ছিটিয়ে দিলে বাষ্পধারা। গরম বাষ্প মুহূর্তের মধ্যে সাফ করে দিল মাটি ঘেঁষে গড়িয়ে-যাওয়া তাল তাল বিষধোঁয়াকে। পরিষ্কার হয়ে গেল মৃত্যু উপত্যকা!
চলল এইভাবেই। পোকামাকড়ের বাসায় ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়ে মানুষ যেভাবে বাসা পরিষ্কার করে নেয়, মঙ্গলগ্রহীরা ঠিক সেইভাবে বিষ-গ্যাস ছড়িয়ে দিতে লাগল লন্ডনের দিকে এগনোর সময়ে। একশো ফুট উঁচু বাক্সে বসে হারামজাদারা ঠিক আঁচ করে নিয়েছে, কোথায় কোথায় লুকানো আছে কামান আর সৈন্য–কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়েছে ঠিক সেইখানে। ধ্বংসস্তূপের পর ধ্বংসস্তূপ রচনা করে বীরদর্পে এগিয়ে গেছে জনবহুল লন্ডন শহরের দিকে। বাধা পায়নি কোত্থাও। বাধা দেওয়ার মতো বেঁচে ছিল না কেউ। মৃত্যুর হাহাকার পর্যন্ত শোনা যায়নি কোনওখানে। তেপায়া দানবরা এসেছে চকিতে, প্রাণের প্রদীপ নিবিয়ে দিয়েছে নিমেষে। গণহত্যা চালিয়ে গেছে নির্মমভাবে।