ওপরতলায় গেলাম দুজনে। জানলা দিয়ে তাকালাম মৃত্যু উপত্যকার দিকে। উষার আলোয় দেখা যাচ্ছে ধ্বংসস্তূপ। মড়া ছড়িয়ে সর্বত্র। কামানগাড়িগুলো উলটে ভেঙেচুরে পড়ে আছে উপত্যকাময়। যেন খেলনার গাড়ি। ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মানুষ আর ঘোড়া, পোড়া গাছ আর ঘাস, ধোঁয়া আর আগুন–যেন শ্মশানভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো উপত্যকাটা। করাল আকৃতি নিয়ে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা যন্ত্রদানব।
প্রান্তরব্যাপী মৃত্যুর হাহাকার। চোখে জল এসে গেল দুজনেরই। বেশ বুঝলাম, এ বাড়িও আর নিরাপদ নয়। চম্পট দেওয়া দরকার এখুনি।
সৈনিক পুরুষ বললে, আমি বরং ফিরে যাই আমার বাহিনীতে।
আর আমার কাজ হবে স্ত্রী-কে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া।–বললাম আমি।
পকেট ভরতি খাবারদাবার নিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। গাছের পাতা নড়লেও চমকে উঠছি দুজনেই। ঘন ঘন দেখছি আশপাশে–বিশ্বাস নেই। যন্ত্রদানবদের-রশ্মি নিক্ষেপ করতে পারে যে-কোনও মুহূর্তে।
ভয়ে কাঠ হয়ে পা টিপে টিপে পেরিয়ে এলাম একটা জঙ্গল। পৌঁছালাম একটা রাস্তায়। দেখলাম, ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে একজন সেনাধ্যক্ষ। দূরে সার বেঁধে যাচ্ছে একদল সেনানী।
ছুটে গেল আমার সঙ্গী, স্যার, ফিরে যাচ্ছি আমার বাহিনীতে। মঙ্গলগ্রহীরা কিন্তু এই রাস্তা বরাবর রয়েছে।
দেখতে কীরকম বেটাদের?–ভুরু কুঁচকে শুধায় অশ্বারোহী সেনাধ্যক্ষ।
-ধাতু দিয়ে তৈরি দানব। একশো ফুট উঁচু। আগুন ছুঁড়ে মারে মাথার ওপরকার বাক্স। থেকে।
ননসেন্স!
মোটেই না। সব সত্যি!–পাশ থেকে বললাম আমি।
ব্যঙ্গের হাসি হেসে ঘোড়া ছুটিয়ে উধাও হল সেনাধ্যক্ষ। গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না আমাদের হুঁশিয়ারি। ঠেলা বুঝবেখন রশ্মিবর্ষণ শুরু হলে।
একটু এগতেই দেখলাম, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সৈন্যরা প্রত্যেককে বলছে জিনিসপত্র ফেলে রেখে এখনই চলে যেতে। কিন্তু শুনছে না কেউ। চরমে উঠেছে কথা কাটাকাটি। একজনের বড় মায়া ফুলের টবগুলোর ওপর। ব্যাগ ভরতি করে নিয়েছে। কড়া গলায় বারণ করছে। একজন সোলজার। কিন্তু কে কার কথা শোনে। প্রত্যেকেই কিছু-না-কিছু নিয়ে যেতে চায়। বাড়ি থেকে, অথচ খালি হাতে এখুনি তল্লাট ছেড়ে চম্পট দেওয়ার হুকুম দিয়ে যাচ্ছে সোলজাররা। হট্টগোলে কান পাতা দায়।
ফুলের টব না নিয়ে যে যাবে না, তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। ধমক দিয়ে বললাম, রাস্তার ওদিকে, জঙ্গলের ওপারে কী আছে জানেন?
না তো? টবগুলো আঁকড়ে ধরে অসহায়ভাবে বললে ফুল-পাগল লোকটা।
মৃত্যু! মৃত্যু! মৃত্যু! তেড়ে আসছে এদিকে। তীব্রস্বরে ফেটে পড়েছিলাম মৃত্যু-উপত্যকার মাঝে টহলদার যন্ত্রদানবগুলোর কথা মনে পড়তেই।
রাত হল। আকাশে তারা ফুটল। একটা মাঠের ওপর ছটা বিরাট কামানের পাশে গোলন্দাজদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মাঠের শেষ প্রান্তেও সারি সারি কামান আর সৈন্য দেখা যাচ্ছে তারার ম্লান আলোয়।
পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনলাম গোলন্দাজবাহিনীর কথাবার্তা।
–একটা-না-একটা গোলা খেতেই হবে বাছাধনদের।
বিদ্যুতের চেয়েও জোরে ছোটে এই কামানের গোলা–ঠেলাটা বুঝবে এবার।
থমকে দাঁড়ালাম সেনাধ্যক্ষের পাশে। বয়স্ক পুরুষ। এক মুখ দাড়ি। চোখ কঠোর। চাহনি দূরে নিবদ্ধ। কথা বলছে আপন মনে। আত্মবিশ্বাস ক্ষরিত হচ্ছে প্রতিটি শব্দ থেকে। থামাবই–এই মাঠ পেরিয়ে আর এগতে হচ্ছে না লন্ডনের দিকে। কামানে কামানে ছেয়ে রাখা হয়েছে এখান থেকে লন্ডন পর্যন্ত। সব কটাকেই শেষ করব এখানেই।
আত্মশ্লাঘার অবসান ঘটল ঠিক সেই মুহূর্তে। আচম্বিতে মাটি কাঁপিয়ে অন্ধকার প্রান্তরে আবির্ভূত হল তিনটে প্রকাণ্ড যন্ত্রদানব। রুখে দাঁড়াল গোলন্দাজবাহিনী।
আমরা কিন্তু দৌড়াচ্ছিলাম। প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়ালাম। নিরস্ত্র কোনও নাগরিকই দাঁড়িয়ে রইল না ভয়াবহ লড়াইয়ের পরিণতিটা দেখবার জন্যে।
পেছন ফিরে আমি কিন্তু দেখেছিলাম, একসঙ্গে গর্জে উঠেছে ছটা কামান। শূন্যপথে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে যাচ্ছে কয়েকটা বোমা। শনশন করে যন্ত্রদানবদের আশপাশ দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে কামান-নিক্ষিপ্ত ধ্বংসদূতেরা। তারপরেই একটা গোলা আছড়ে পড়ল একটা ধাতুময় তেপায়া দানবের ওপর–নির্ভুল লক্ষ্যে!
অগ্নিঝলকে ক্ষণেকের জন্যে দেখেছিলাম, কালো কালো ছায়ামূর্তির মতো গোলন্দাজবাহিনী ক্ষিপ্তের মতো কামানের নল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শেল দেগে যাচ্ছে। অনেক উঁচুতে রক্ত-জমানো আকৃতি নিয়ে মহাকায় একটা তেপায়া দানব তাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল বলে। দূরে, পেছনে দেখা যাচ্ছে, নির্ভয়ে এগিয়ে আসছে আরও দুটো বিদঘুটে দানব। ঠিক সেই সময়ে একদম সামনের কিম্ভুত আকৃতিটার একটা পা খানখান হয়ে গেল শেল বিস্ফোরিত হতেই। দিকে দিকে বিচ্ছুরিত হল অগ্নিঝলক–টুকরো টুকরো যন্ত্রাংশ ঠিকরে গেল আশপাশে।
জয়োল্লাসে ফেটে পড়ল সেনাবাহিনী। এই প্রথম ঘায়েল করা গেছে একটা দানবকে! সত্যিই ঘায়েল হয়েছে অজেয় যন্ত্রদানব। মারাত্মক চোট পেয়েছে। ভাঙা পায়ের ওপর বিরাট দেহটা টলমল করে উঠেই আছড়ে পড়ল দড়াম করে।
মুহূর্তের মধ্যে কিন্তু বিপর্যয় ঘটিয়ে ছাড়ল জখম যন্ত্রদানবের সঙ্গী দুজন। তাপরশ্মি বর্ষিত হল ঝলকে ঝলকে সেনাবাহিনীর ওপর। কামান-বন্দুক-গোলাবারুদে আগুন ধরে গেল চক্ষের নিমেষে। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল সঙ্গে সঙ্গে। ভয়াবহ সেই বিস্ফোরণের তুলনীয় বিস্ফোরণ জীবনে কখনও শুনিনি বা দেখিনি। সৈন্যসামন্ত পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হল ওই একটা বিস্ফোরণেই। অগ্নিঝলকের মধ্যে দিয়ে শুধু দেখলাম, বহু উঁচুতে ঠিকরে যাচ্ছে। সৈন্যদের লাশ!