আচম্বিতে সবুজ আলোয় সবুজ হয়ে গেল সমস্ত পথ। মাথার ওপরকার মেঘের রাশি চিরে সবুজ আগুন বর্শাফলকের মতো এসে পড়েছে সবুজ পৃথিবীর ওপর। আশ্চর্য সেই আগুন আর আলো দেখেই পলকের মধ্যে বুঝলাম, কী ঘটে গেল।
তৃতীয় সিলিন্ডার এসে পড়ল আমার ঠিক বাঁদিকের মাঠে।
একই সঙ্গে যেন রকেট বিস্ফোরিত হল মাথার ওপর। যুগপৎ বজ্রনাদ আর বিদ্যুতের ঝলকানিতে খেপে গেল আমার ঘোড়া। নক্ষত্রের বেগে ছুটল গাড়ি নিয়ে। বৃথাই রাশ টেনে ধরবার চেষ্টা করলাম আমি।
তুফান মাথায় নিয়ে ধেয়ে গেলাম এইভাবে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আশপাশে, বাজ পড়ছে কড় কড় কড়াৎ শব্দে, ছুঁচের মতো বৃষ্টি বিধছে মুখে। পাগলা ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। চাবুক মেরেও শায়েস্তা করতে পারছি না। নজর রেখেছি কেবল রাস্তার ওপর। মাঠেঘাটে না নেমে পড়ে।
হঠাৎ দেখলাম, কী যেন একটা সোত করে নেমে গেল পাহাড়ের গা বেয়ে উলটোদিকে।
যা দেখলাম, তা আমার রক্ত জমিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট! বর্ণনা করবার ভাষা কি আমার আছে? লম্বা লম্বা পাইন গাছের মাথা টপকে হনহন করে দৌড়াচ্ছে একটা তেপায়া দানব! মড়মড় করে গাছ ভেঙে যাচ্ছে ঠ্যাঙের ধাক্কায়। চকচকে ধাতু দিয়ে গড়া দেহ! দানব নিঃসন্দেহে–তবে রক্তমাংসের নয়–ধাতুর। বিশাল ইঞ্জিন হেঁটে চলেছে… ছুটে চলেছে… গাছপালা ভেঙে পথ করে নিচ্ছে .. কখনও সখনও লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে টপকে যাচ্ছে।
পরক্ষণেই আমার ঠিক সামনের গাছগুলো দুদিকে সরে গেল–ফাঁকে আবির্ভূত হল আর-একটা ধাতুময় তেপায়া দানব। টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আমি চলেছি ঠিক তার দিকেই!
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাগাম টেনে ধরেছিলাম। শিরপা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বেচারি অশ্ব। নিমেষমধ্যে তার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম ডানদিকে।
আচমকা ওইভাবে বাঁক নিলে দুর্ঘটনা ঘটবে, এ আর আশ্চর্য কী! গাড়ি উলটে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ওপরের আসন থেকে আমি ঠিকরে পড়লাম রাস্তার পাশে একটা খানায়।
জলে পড়েছিলাম বলেই বেঁচে গেলাম সে যাত্রা। হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসে লুকিয়ে রইলাম একটা ঝোপের মধ্যে। আমার পাশ দিয়েই একশো ফুট উঁচু চলন্ত আতঙ্কটা দমাস দুম শব্দে হাঁটতে হাঁটতে উঠে গেল পাহাড় বেয়ে ওপরদিকে।
ঝোপের মধ্যে থেকেই শুনতে পেলাম, হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে অদ্ভুত চিৎকার করছে তেপায়া দানব, আলু-উ-উ! আলু-উ-উ!
ডাক শুনেই বোধহয় ছুটে এল অন্য দানবটা মুখোমুখি হল দুজনে। আবার অপার্থিব সেই গর্জনে কেঁপে উঠল দিগদিগন্ত।
পাশাপাশি হেঁটে গেল দুজনে মাঠের মধ্যে। হেঁট হয়ে কী যেন খুঁজছে। নিশ্চয় তৃতীয় চোঙার সন্ধানে বেরিয়েছে। দূর থেকে মিনিটকয়েক ধরে দেখে গেলাম তাদের অন্বেষণপর্ব।
তারপরেই গুটিগুটি বেরিয়ে এলাম খানার মধ্যে থেকে। অন্ধকারে গা ঢেকে পাঁইপাঁই করে দৌড়ালাম পাইন অরণ্যের দিকে।
উদ্দেশ্য আমার একটাই–বাড়ি পৌঁছাতে হবে যেভাবেই হোক। অনেক ছুটে, অনেক কষ্ট করে, অনেক বিপদ পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছালামও।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম বটে, কিন্তু একটু পরেই বাইরে একটা আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়।
বাগানের অন্ধকারে দেখলাম একটা ছায়ামূর্তিকে। আমার দিকেই আসছে। একটু এগতেই দেখলাম তার ছন্নছাড়া বেশ। উদভ্রান্ত চেহারা। মঙ্গলগ্রহীদের কবলে পড়েছিল মনে হচ্ছে।
হেঁকে বললাম, ভেতরে আসুন–যদি লুকিয়ে বাঁচতে চান।
যা।–বলে দৌড়ে এল পুরুষমূর্তিটি।
যা।-বলে দৌড়ে এল পুরুষমূর্তিটি।
ঘরের আলোয় তাকে দেখলাম ভালো করে। বললাম সবিস্ময়ে, আপনি সোলজার? ব্যাপার কী বলুন তো?
যেন ককিয়ে উঠল জোয়ান সৈনিক পুরুষ, ব্যাপার অতি ভয়ানক! টিপে মেরেছে বলতে পারেন। মৃত্যু আর ধ্বংসের স্রোত বইয়ে দিয়েছে! কেউ আর বেঁচে নেই!
–বলছেন কী!
কামান গাড়ি চালাই আমি। কামান নিয়ে যাচ্ছিলাম বালির গর্তটার দিকে… একটা গর্তে পা পড়েছিল আমার ঘোড়ার… ছিটকে পড়েছিলাম খানায়–নিষ্প্রভ চোখে ক্লান্ত কণ্ঠে বলে চলে ছন্নছাড়া সৈনিক, আচমকা কামান গর্জন শুনলাম পেছনে–মাথার ওপর দিয়ে শনশন করে চলে গেল গোলার পর গোলা… বিস্ফোরণের আওয়াজে কান যখন ভোঁ ভোঁ করছে, ঠিক তখনই আগুন আর মৃত্যু দেখলাম চারপাশে। তেপায়া দানব!… তেপায়া দানব! মারণ রশ্মি ছুঁড়ে চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে ধ্বংস করে দিল সবকিছু! ও ভগবান! কামান ঠিকরে গেল! মানুষ ছিটকে গেল! ঝলকে ঝলকে রশ্মি এসে আগুন জ্বালিয়ে দিলে চারধারে। মড়ার পাহাড় জমে উঠল আমার ওপর–বেঁচে গেলাম শুধু সেই জন্যেই।
তারপর? তারপর?–রুদ্ধশ্বাসে বলেছিলাম আমি।
কাঠ হয়ে পড়ে রইলাম তারপরেও অনেকক্ষণ। দূরে দূরে দেখা যাচ্ছিল ভয়ংকর দানবদের কী বিরাট! কী বিকট! বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়ে গিয়েছিল কিম্ভুতকিমাকার ওই চেহারা দেখেই।
–শেষ পর্যন্ত হল কী?
-কী আর হবে? গুটিগুটি বেরিয়ে এলাম মড়ার গাদা ঠেলে… অতি কষ্টে এসেছি এদূর।
সৈনিক পুরুষের ক্লান্ত, অবসন্ন মুখচ্ছবি দেখে মনটা মুচড়ে উঠল আমার। হতাশায় ভেঙে পড়েছে একেবারেই। পরাজয় যে এত নিষ্করুণ হতে পারে, ভাবতে পারেনি কামানচালক। কামানের গোলাও যাদের কিছু করতে পারে না, তারা যে কী বিভীষিকা, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার পর।