সারারাত ধরে মঙ্গলগ্রহীদের ঘিরে রেখেছে আমাদের সৈন্যবাহিনী। খতম করার ইচ্ছে নেই আপাতত। বাড়াবাড়ি করলে অবশ্য মরবে।
দুধের ডোল গয়লার হাত থেকে নিতে নিতে বলেছিলাম, শুনলাম, কাল রাতে আর একটা সিলিন্ডার এসে পড়েছে। একটাতেই রক্ষে নেই, আরও একটা জুটল দেখছি!
যেতে যেতে বলে গিয়েছিল গয়লা, লোকসান তো ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির। ঝুটঝামেলা মেটবার পর ক্ষয়ক্ষতি মেটাতে ফতুর হয়ে যাবে।
প্রাতরাশ খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম কমন প্রান্তরের দিকে। পুলটার কাছেই মুখোমুখি হলাম দুজন সৈনিক পুরুষের সঙ্গে। ব্রিজ আগলে দাঁড়িয়ে বন্দুক হাতে।
রুখে দিল আমাকেও, দুঃখিত স্যার, আর এগনোর হুকুম নেই।
গল্প জুড়ে দিলাম ওইখানেই দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, মঙ্গলগ্রহীদের স্বচক্ষে দেখেনি দুজনের কেউই। পাহারাই দিয়ে যাচ্ছে। আমি তখন বললাম, কী দেখেছি গত রাতে। তাপরশ্মির প্রলয়লীলা বর্ণনা করতে করতে ফের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল নিজেরই।
শুনেটুনে একজন সৈনিক বললে, মাটি ঘেঁষে গুঁড়ি মেরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেই বুঝবে বাছাধনরা।
অপরজন কাষ্ঠ হেসে বললে, তা না-হয় হল, কিন্তু তাপরশ্মি থেকে গা বাঁচাবে কী করে? ওভাবে হবে না হে–দূর থেকেই কামান দেগে শেষ করে দিতে হবে শয়তানের বাচ্চাদের।
বাড়ি ফিরে এলাম। নতুন খবর আর পেলাম না এত হাঁটাহাঁটি করেও। গরম পড়েছিল বেশ। সস্ত্রীক খেতে বসলাম ঘরের বাইরে–বাগানে।
দিব্যি শান্ত চারদিক। মোমবাতি জ্বলছে টেবিলে। খাচ্ছি নিশ্চিন্ত মনে। আচমকা শোনা গেল গুলিবর্ষণের শব্দ। একই সঙ্গে ভীষণ শব্দে হুড়মুড় করে কী যেন ভেঙে পড়ল। এত জোরে, যে মাটি কেঁপে উঠল থরথর করে। জ্বলন্ত মোমবাতি তিনটে ছিটকে গেল টেবিল থেকে। আঁতকে উঠল আমার স্ত্রী।
ভয়বিহ্বল চোখে দেখলাম সেই ভয়াবহ দৃশ্য! কাছের গাছগুলোর চুড়োয় আগুন লাগছে একে একে–নিমেষে নিমেষে জ্বলে উঠছে দাউদাউ করে, আর…
ছোট গির্জের চুড়োটা ভেঙে আছড়ে পড়ছে মাটিতে।
তাপরশ্মি! প্রলয়ংকর তাপরশ্মি ঝলকিত হচ্ছে সবকিছুর ওপর! রাতের অন্ধকার চিরে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে করাল রশ্মির কোপে।
আমার বাড়ি একটা টিলার ওপর। উঁচু থেকে দেখলাম এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য। চকিতে বুঝলাম, যে উচ্চতায় ধেয়ে আসছে ওই রশ্মি, রেহাই দেবে না হয়তো পাহাড়চুড়োর এই বাড়িকেও। নাগালের মধ্যেই রয়েছে যে!
হলও তা-ই। বাগান থেকেই দেখতে পেলাম, বাড়ির মাথায় দুটো লম্বা চিমনির একটা আচমকা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল–ঠিক যেন কামানের গোলায় গুঁড়িয়ে গেল প্রস্তর চিমনি।
তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে বলেছিলাম রুদ্ধশ্বাসে, অসম্ভব! এখানে থাকা আর যাবে না!
আতঙ্কে কাঠ হয়ে গিয়ে তারস্বরে বলেছিল স্ত্রী, কিন্তু যাবেটা কোথায়?
লেদারহেডে তোমার ভায়েদের বাড়িতে বউকে ঠেলে বাড়ি থেকে বার করতে করতে বলেছিলাম গলার শির তুলে।
পাহাড় থেকে বেগে নামতে নামতেই দেখলাম, টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে একদল সৈন্য। দুজন তড়াক করে নেমে পড়ল ঘোড়ার পিঠ থেকে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হেঁকে বলতে লাগল, পালান! পালান! মঙ্গল গ্রহের আতঙ্করা এদিকেই আসছে!
ঝটপট চলে গেলাম গাঁয়ের সরাইখানায়। মালিকের একটা এক-ঘোড়ার গাড়ি আছে জানতাম। আস্তাবলেই দেখলাম ভয়ার্ত ঘোড়াটাকে পা ঠুকতে। মালিকও বেরিয়ে এসেছিল আমাকে দেখে।
দ্রুতকণ্ঠে বলেছিলাম, দুপাউন্ড ভাড়া দেব–আজ রাতেই ফিরে পাবেন আপনার গাড়ি ঘোড়া সমেত।
ভাড়াটা খুব বেশি। কাজেই এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল সরাইখানার মালিক। ঝটিতি বাড়ি এসে দরকারি জিনিসপত্র প্যাক করে নিলাম। গাড়িতে এনে রাখলাম। বউকে নিয়ে পাশাপাশি বসলাম চালকের আসনে। চাবুক হাঁকড়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম তক্ষুনি।
দেখতে দেখতে এসে পড়লাম পরিচ্ছন্ন প্রশান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে। ধোঁয়া আর আওয়াজ পড়ে রইল পেছনে। রোদ ওঠার পর দেখলাম, দুপাশের ঝোপে অগুনতি গোলাপ ফুল। মিষ্টি রোদ্দুরে যেন হাসছে।
পাহাড়ের মাথায় উঠে তাকিয়ে দেখেছিলাম পেছনে। রাশি রাশি কালো ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়ে গেছে। ধোঁয়ার মধ্যে থেকে ঝলসে উঠছে লাল আগুন। পূর্ব আর পশ্চিমে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে তাল তাল ধোঁয়া। তার মানে, মঙ্গলগ্রহীরা নারকীয় উল্লাসে অগ্নিসংযোগ করছে সবকিছুতেই। তাপরশ্মির পাল্লায় যা পড়ছে, ছারখার করে দিচ্ছে বিকট বিধ্বংসী লালসায়। পূর্ব থেকে পশ্চিমে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস! চোখে জল এসে গেল আমার।
নির্বিঘ্নে পৌঁছালাম লেদারহেডে। সংবর্ধনা জানাল স্ত্রী-র ভায়েরা। ব্যাপার কী জানতে চাইল গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই।
সব বললাম। ঘণ্টাখানেক জিরেন দিলাম ঘোড়াটাকে। তারপরে স্ত্রী-কে ওদের হেপাজতে রেখে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির দিকে।
তখন রাত হয়েছে। আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার বেশ গাঢ়। মেঘপুঞ্জও যেন ভারী হয়ে ঝুলে পড়ছে। দরজার আলোর সামনে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। স্ত্রী-কে। মুখ সাদা। দূর হতে হতে দূরে মিলিয়ে গেল সেই মূর্তি।
ঝড়ের বেগে পেরিয়ে গেলাম একটার পর একটা বাড়ি। সব বাড়িই কালচে মেরে গেছে। সাড়াশব্দও নেই। চলেছি যেন গোরস্থানের মধ্যে দিয়ে। থমথম করছে চারদিক। ঠিক পেছনেই মধ্যরাতের ঘণ্টা বেজে উঠল একটা গির্জাতে।