আমি একাই জীবন নিয়ে শুধু ফিরে এসেছিলাম মৃত্যু-যজ্ঞ থেকে। আমার পেছনে তারার আলোয় গর্তের চারধারে দেখা যাচ্ছিল প্রায় চল্লিশটা মৃতদেহ।
ওগিলভি আর হেন্ডারসনও ছিল ওদের মধ্যে। পাশাপাশি দুজনে পড়ে ছিল নিথর চাহনি আকাশের পানে মেলে ধরে–শান্তির বাণী নিয়ে গিয়ে জীবন আহুতি দিয়েছিল চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে।
তখন, সেই পলায়নের মুহূর্তে, কোনও চিন্তাই আমার মাথায় ছিল না… কারও কথাই ভাবিনি… ভাবতে পারিনি… সমস্ত সত্তা জুড়ে বিরাজ করছিল অবর্ণনীয় এক আতঙ্ক… সে আতঙ্কবোধকে ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু মনে আছে, আমি দৌড়াচ্ছি… দৌড়াচ্ছি… দৌড়াচ্ছি! হোঁচট খাচ্ছি, আছড়ে পড়ছি, তেড়েমেড়ে উঠে আবার ছুটছি৷ দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে আতঙ্ক-অঞ্চল থেকে নিমেষে দূরে সরে এসেছি। তারপর পুলের এপাশে রাস্তায় পৌঁছেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম। নাক-মুখ কেটে রক্তারক্তি হয়েছিল। বোধহয় বেহুশ হয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ।
অবশেষে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। টলতে টলতে এবং কাঁপতে কাঁপতে পুল পেরিয়ে গিয়েছিলাম এক হাতে কপাল খামচে ধরে। পেছনে পড়ে ছিল নিস্তব্ধ প্রান্তর। মনে হয়েছিল যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরে ছুটে এলাম এতটা পথ।
কিছু দূর এসে দেখলাম, মেবেরি ব্রিজের ওপর দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছুটছে একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে দক্ষিণদিকে। পাশের উঠোন থেকে বেশ কয়েকজনের কথাবার্তাও কানে এল। সবই চেনা, জানা এবং রোজকার দেখা–কিন্তু এইমাত্র যে লেলিহান মৃত্যুকে ফেলে এলাম পেছনে, তার সঙ্গে মিল নেই কোথাও!
ঢুকলাম শহরে। গ্যাসবাতির তলায় জনাকয়েকের জটলা দেখলাম। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম, কমনের নতুন কোনও খবর আছে কি না। আমার রক্ত-মাখা ধূলিধূসরিত উদভ্রান্ত মূর্তি দেখেই ওরা বুঝেছিল, কোত্থেকে আসছি আমি। তাই পালটা প্রশ্ন করেছিল আমাকে, আপনিই তো আসছেন ওখান থেকে? বলুন তো কী খবর?
খবর খুব খারাপ! মঙ্গল গ্রহের মানুষ এসে নেমেছে প্রান্তরে বলেছিলাম শুষ্ককণ্ঠে।
তাচ্ছিল্যের আর অবিশ্বাসের হাসি হেসেছিল রাস্তার লোকেরা। ধন্যবাদ জানিয়ে সরে পড়েছিল তক্ষুনি। বোধহয় পাগলই ভেবেছিল আমাকে আমার চেহারা দেখে।
মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল আমার। বোকার মতো অত কথা না বললেই হত। টিটকিরি সহ্য করতে হত না। কয়েকজনের পেছন পেছন ধাওয়া করেছিলাম রাগের মাথায়। স্বচক্ষে যা দেখেছি, তার বর্ণনা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেনি।
ভীষণ রেগে তখন বলেছিলাম, টের পাবেন শিগগিরই!
বাড়ি ফিরে এসে বউকে বলেছিলাম, এইমাত্র কী ভয়ানক কাণ্ড দেখে এলাম। টেবিলে রাতের খাবার সাজানো রয়েছে দেখে এক গেলাস সুরাপান করেছিলাম স্নায়ু চাঙ্গা করার জন্যে।
সব শেষে বলেছিলাম, একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল।
কী?–জিজ্ঞেস করেছিল স্ত্রী।
–গর্ত ছেড়ে নড়বে না মঙ্গলগ্রহীরা। ধারেকাছে কেউ গেলেই খতম করে দেবে।
–আসতেও তো পারে এখানে।
–না, না, আসবে না।
–কেন বল তো?
–নড়তেই পারে না। ওই গতর নিয়ে কোনওমতে বেরিয়েছে চোঙার বাইরে–সে যে কী কষ্টে, না দেখলে বুঝবে না। কেন জান? পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে তিনগুণ বেশি। তার মানে, একজন মঙ্গলগ্রহীর মঙ্গল গ্রহে যা ওজন, পৃথিবীতে তার তিনগুণ বেশি ওজন। ওজন বাড়ছে, কিন্তু গায়ের জোর তো বাড়ছে না। কাজেই চলতে ফিরতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে।
খেয়েদেয়ে ধাতস্থ হলাম।
বউ বললে, এতই যদি অসহায় তো এত লোক মারতে গেল কেন?
–আমার তো মনে হয় স্রেফ ভয়ে। ভীষণ ভয় পেলে মাথার কি ঠিক থাকে? হতভাগারা জানে না, বেশি বাড়াবাড়ি করলে গর্তে একটা বোমা ফেলে দিলেই ল্যাটা চুকে যাবে। ঝাড়েবংশে মারা যাবে প্রত্যেকে।
অনেক কথা হল খেতে খেতে। পরম শান্তিতে ডিনার-পর্ব শেষ করেছিলাম সেই রাতে। তারপর কেটেছে অনেক ভয়ংকর রাত অনেক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। শেষ ডিনারের সেই সুখস্মৃতি ভুলতে পারিনি দুঃসহ উল্কণ্ঠা আর অবসাদের মধ্যে।
উত্তেজনার চোটে কিন্তু সেই রাতে একটা ব্যাপার একেবারেই খেয়াল করিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম–যন্ত্রবিদ্যায় মঙ্গলগ্রহীরা এতই উন্নত যে, নিজেদের শরীর হঠাৎ গুরুভার হয়ে যাওয়ার বাধা কাটিয়ে নেওয়ার মতো যান্ত্রিক কৌশল নিশ্চয় ভেবে বার করবে। করেওছিল তা-ই। সমস্ত রাত ধরে ধু ধু কমন-প্রান্তরে চলেছিল সেই প্রস্তুতি। বানিয়েছিল একটার পর একটা মেশিন। যে মেশিনে চেপে অথর্ব দেহ নিয়েও তারা নরক। সৃষ্টি করবে সবুজ এই পৃথিবীতে। চোঙার বাইরে এসে গুরুভার দেহ নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে তারা খাড়া করেছিল একশো ফুট উঁচু অদ্ভুত আকৃতির ভয়াল যন্ত্র!
রাত এগারোটা নাগাদ দুদল সৈন্যবাহিনী পৌঁছেছিল কমন প্রান্তরে। প্রান্তর ঘিরে সৈন্য সাজানো হয়েছিল তৎক্ষণাৎ। অন্ধকারে শুধু ঠাহর করা গিয়েছিল, সারি সারি কামান নলচে ফিরিয়ে রয়েছে গর্তের দিকে। ঘোড়ায় চেপে তদারক করছে সেনাধ্যক্ষরা। সারি সারি সৈনিক বন্দুক হাতে তৈরি। শুধু হুকুমের অপেক্ষা।
রাত ঠিক বারোটার কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার খসে পড়েছিল একটা তারা। আবির্ভূত হয়েছিল দ্বিতীয় সিলিন্ডার!
পরের দিনটা কেটেছিল নিদারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে। রোজকার মতো সকালে দুধ দিতে এসেছিল গয়লা। দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি, নতুন কোনও খবর আছে?