আচমকা চেঁচিয়ে উঠল একজন শাবলধারী, হুশিয়ার! চোঙার ঢাকনা খুলে যাচ্ছে .. পেঁচিয়ে খোলা হচ্ছে ভেতর থেকে।
খুলে গেল ঢাকনা। দড়াম করে পড়ল চোঙার গায়ে। ঝুলতে লাগল চকচকে চাকার মতো।
সভয়ে সরে এসেছিল কৌতূহলী মানুষগুলো। হেঁকে সরিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। কী আছে ভেতরে, তা যখন জানা নেই–তখন তফাত যাওয়াই ভালো।
হতভম্ব চোখে আমি চেয়ে ছিলাম ভোলা গর্তটার দিকে। হেলে-পড়া অদ্ভুত কারুকাজ করা বিশাল সিলিন্ডারের ওপরদিককার ছোট হ্যাঁচের মতো একটা ফোকর হঠাৎ উন্মুক্ত হয়েছে। না জানি এবার কী বিস্ময় আবির্ভূত হবে ফোকর দিয়ে।
মানুষই উঁকি মারবে, আশা করেছিল সবাই। আমি নিজেও তা-ই ভেবেছিলাম। কিন্তু ছায়ার মধ্যে দিয়ে যা দেখলাম, তা আর যা-ই হোক–মানুষের চোখ নয়।
গনগনে দুটো বস্তু, গোল চাকার মতো বস্তু, চেয়ে আছে আমাদের দিকে। তারপরেই ধূসর সর্পের মতো কী যেন একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠল ফোকরের মধ্যে থেকে লকলকিয়ে শূন্যপথে এগিয়ে এল আমার দিকে।
হট্টগোলটা শুরু হল তৎক্ষণাৎ। বীভৎস ওই শুড়ের লকলকানি দেখেই ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল যাদের, তাদের মধ্যে সবার আগে গলার শির তুলে চিৎকার করে উঠল একটি মেয়ে। দুদ্দাড় করে পালাতে লাগল যে যেদিকে পারে।
আমি কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলাম থ হয়ে। দাঁড়িয়ে ছিলাম বলেই দেখতে পেলাম, অক্টোপাসের বাহুর মতো কদর্য শুড় বেরিয়ে আসছে একটার পর একটা। কিলবিল করছে ছোট্ট ফোকরের চারপাশে। শুড় দিয়ে চোঙার গা চেপে ধরে পরক্ষণেই বেরিয়ে এল একটা মূর্তিমান আতঙ্ক!
বীভৎস! কোনও প্রাণী যে এত কদাকার হয়, জানতাম না। ধূসর বর্ণের বৃহৎ বপুটাকে একটু একটু করে এবং বেশ কষ্টের সঙ্গে নিয়ে এল চোঙার বাইরে অমানবিক দুটো বিশাল চক্ষু। একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমার দিকে। বিকটাকার চোখ দুটোর দিকে আমিও চেয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে। চোখ প্রত্যঙ্গ দুটো তো মুন্ডুতে থাকে জানি। কিন্তু এর মুন্ডু কোথায়? সবটাই তো ধড়। অথবা ধড়টাই ওর পুরো মগজ। নারকীয় জিঘাংসা-ধকধকে চোখ দুটো বসানো রয়েছে কুৎসিত এই ধড়ের ঠিক মাঝখানে।
পুরো অবয়বটাকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে ফেলেছিল পৈশাচিক এই প্রাণী। এবার আচমকা চোঙার গা বেয়ে হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়ল নিচের গর্তে। ধুপ করে আছাড় খেতেই কাতরে উঠল অদ্ভুত গলায়। সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা অবিকল বিকট প্রাণী আবির্ভূত হল ফোকরের বাইরে।
দু-দুটো কালান্তক প্রাণীকে কটমট করে চেয়ে থাকতে দেখে প্রাণ হাতে নিয়ে জনতা তখন দৌড়াচ্ছে। দৌড়েছিলাম আমিও। উন্মাদের মতো ধেয়ে গিয়েছিলাম একটা গাছের জটলার দিকে। তল্লাট ছেড়ে চম্পট দেবার অভিপ্রায় আমার ছিল না মোটেই। লোমহর্ষক ওই চাউনির আড়ালে থেকে দুঃস্বপ্নসম জীবগুলোকে খুঁটিয়ে দেখবার লোভ সামলাতে পারিনি মোটেই।
গাছপালার আড়ালে গিয়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলাম ধুকপুকে বুকে। ভয়ে-বিস্ময়ে দুচোখ যে প্রায় ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল, তা না বললেও চলে। দূর থেকেই দেখেছিলাম, অক্টোপাসের কিলবিলে বাহুর মতো সরু কালো চাবুক যেন আছড়ে পড়ছে সূর্যাস্তের দিকে। তারপর ঠেলে উঠে এল একটা সরু রড। একটার পেছনে আর-একটা জোড়া লাগিয়ে বেশ লম্বা করে তোলা হল অনেক উঁচুতে। রডের ডগায় বনবন করে ঘুরতে লাগল গোলাকার একটা প্লেট।
হইচই শুনে ফিরে তাকালাম। একদল লোক সাহসে বুক বেঁধে ফিরে এসেছে। গুটিগুটি এগচ্ছে গর্তের দিকে। পুরোধা ব্যক্তির হাতে রয়েছে সাদা নিশান–লাঠির ডগায় বাঁধা। হাওয়ায় উড়ছে পতপত করে।
টিলার ওপর এসে দাঁড়াল ছোট্ট দলটা। ডাইনে-বাঁয়ে পতাকা নেড়ে কথা বলার চেষ্টা করল মঙ্গলগ্রহীদের সঙ্গে।
রডের ডগায় বনবনে ঘুরন্ত চাকাটা আস্তে আস্তে ঘুরে গেল তাদের দিকে…
তারপরেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল তীব্র আলোর ঝলকে। ভক ভক ভক করে তিনবার সবুজ ধোঁয়া গর্তের ভেতর থেকে ঠিকরে গেল আকাশের দিকে।
খুব ধীরে ধীরে কিম্ভুতকিমাকার একটা আকৃতি উঠে এল গর্তের বাইরে। নিক্ষেপ করল একটা আলোকরশ্মি…
অদ্ভুত আকৃতিটার দিক থেকে বিচ্ছুরিত সেই আলোকরশ্মি এমনই জোরাল যে, চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার। শুধু রশ্মি না বলে তাকে রশ্মিপ্রবাহ বললেই ঠিক হয়। তীব্রবেগে আছড়ে পড়ল বন্ধুত্বের বার্তাবাহী মানুষ কজনের ওপর। নিমেষের মধ্যে শূন্যপথে ছিটকে গিয়ে আছড়ে পড়ল প্রত্যেকেই–আর নড়ল না। রশ্মিশক্তি এত প্রচণ্ড হয়? এমন সর্বনাশা হয়? এতখানি মারাত্মক হয়? দাউদাউ করে জ্বলে উঠল পেছনকার পাইনবন–আগুন লকলকিয়ে উঠল শুকনো ঘাসেও।
গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম আমি। তখন অন্ধকার নেমেছে। অত্যুজ্জ্বল আলোকরশ্মি নির্মমভাবে তাণ্ডবনৃত্য চালিয়ে যাচ্ছে। কী ভাগ্যিস, আর-একটু এগিয়ে আসেনি। এলে, আমার দফারফাও হয়ে যেত। গাছপালা সমেত পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম।
অর্ধচন্দ্রাকারে আমার লুকানোর জায়গার ঠিক সামনে দিয়ে সবকিছুতে আগুন লাগাতে ঘুরে গেল অকল্পনীয় সেই আলোকরশ্মি। গাঢ় তমিস্রা শিউরে উঠল যেন অপার্থিব সেই রশ্মি অন্ধকারের বুকে আছড়ে পড়তেই।
আচমকা বিষম আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছিলাম আমি। দৌড়! দৌড়! দৌড়! অন্ধকারের মধ্যে মাঠের ওপর হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়েও ফের ঠিকরে গিয়ে দৌড়েছিলাম পাগলের মতো।