আমি কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভেবেছিলাম। ওগিলভির কথায় মন মানতে রাজি হয়নি। ওই যে অগ্নিঝলক, তা কখনওই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা ঝাঁকে ঝাঁকে উল্কা খসে পড়ার ফলে হচ্ছে না। প্রকাণ্ড কামান দাগলে এমনি ঝলক দেখা যায়। এমনি ধূম্রবলয় ঠিকরে যায়। তবে কি পরপর দশ রাত ধরে গোলার মধ্যে মহাকাশযান পাঠাল মঙ্গলগ্রহীরা পৃথিবীকে টিপ করে?
তারপর এল সেই রাত। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ংকরতম রাত। একটা তারা খসে পড়ল আকাশ থেকে। শেষ রাতের দিকে। সবুজ আলোর একটা রেখা দেখা গেছে নাকি খসে পড়া তারার পেছনে। বেশ কয়েক সেকেন্ড সবুজ আলোটা ভেসেছিল আকাশে। একটা হিসহিস শব্দও শোনা গিয়েছিল খসে-পড়া তারা পৃথিবীর দিকে বেগে ধেয়ে আসার সময়ে।
উল্কাপাত নিয়ে কে আর মাথা ঘামায়। কিন্তু টনক নড়েছিল ওগিলভির। ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়েছিল। দেখেছিল, বিশাল একটা সিলিন্ডার বালির মধ্যে বেশ খানিকটা ঢুকে গেছে আকাশ থেকে বেগে নেমে আসার পর। জমি গর্ত হয়ে গেছে ধাক্কার চোটে। বালি আর পাথর ঠিকরে গিয়ে গোলাকার টিলা বানিয়ে ফেলেছে চারধারে।
উল্কা তো সচরাচর গোলমতো হয়। সিলিন্ডার আকারের তো হয় না। ব্যাস প্রায় নব্বই ফুট। ভেতরে গুড়গুড় করে কী যেন আওয়াজ হচ্ছে। এত গরম যে কাছে যাওয়াও সম্ভব নয়।
চোঙাটা যে ফাঁপা হতে পারে, এ ধারণা তখনও মাথায় আসেনি ওগিলভির।
স্তম্ভিতের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ওগিলভি। দেখেছিল, প্রচণ্ড বেগে মাটিতে আছড়ে পড়ার আগে ফার গাছগুলোকে প্যাঁকাটির মতো ভাঙতে ভাঙতে নেমে এসেছে সিলিন্ডারটা। জঙ্গলেও আগুন লেগেছে। ধোঁয়া উঠছে।
হঠাৎ চমক ভেঙেছিল ওপর থেকে ঝুরঝুর করে কী পড়ছে দেখে। সিলিন্ডারের ওপরের দিকে ছাইয়ের মতো খোসা খসে খসে পড়ছে গর্তের মধ্যে। কেন পড়ছে? একদৃষ্টে চেয়ে থাকতেই রক্ত জল হয়ে গেল ওগিলভির।
সিলিন্ডারের ওপরের দিকে ঠিক যেন একটা ঢাকনা আঁটা রয়েছে। পেঁচিয়ে আঁটা। আস্তে আস্তে ঘুরছে সেই ঢাকনা। অর্থাৎ প্যাঁচ খুলে যাচ্ছে।
ভেতরে তাহলে কেউ রয়েছে। এখনও মরেনি! চোঙাটাও নিরেট নয়–ফাঁপা!
হয়তো ভেতরে মানুষ আছে, আধমরা মানুষটাকে সাহায্য করা দরকার–এই ভেবেই হাঁচোড়-পাঁচোড় করে টিলার গা বেয়ে গরম চোঙার দিকে এগিয়েছিল ওগিলভি। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বিদ্যুৎ চমকের মতো সম্ভাবনাটা খেলে গিয়ে ছিল মাথার মধ্যে!
মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেনি তো এই সিলিন্ডার? ভেতরে যে বা যারা রয়েছে, মঙ্গল গ্রহের জীব নয় তো তারা?
তবুও গুটিগুটি কাছে গিয়েছিল ওগিলভি। কিন্তু চোঙার গায়ে হাত দিতেই ছ্যাঁকা লেগে গিয়েছিল হাতে। দারুণ গরম। উন্মাদের মতো বেরিয়ে এসেছিল তৎক্ষণাৎ গর্তের বাইরে। সিলিন্ডার পড়ে ছিল শহরের বাইরে ফাঁকা জায়গায়। এখন ঊর্ধ্ব- শ্বাসে ছুটল দূরের শহরের দিকে। প্রথমেই দেখা হয়ে গেল হেন্ডারসনের সঙ্গে।
হেন্ডারসন পেশায় সাংবাদিক। লন্ডনের একটা খবরের কাগজের রিপোর্টার। বাড়ির সামনে বাগানের মাটি কোপাচ্ছিল কোদাল দিয়ে।
হন্তদন্ত হয়ে বাগানে ঢুকে পড়েছিল ওগিলভি। বলেছিল চিৎকার করে, হেন্ডারসন, কাল রাতে তারা খসে পড়া দেখেছিলে?
ওগিলভির মতো বৈজ্ঞানিকের এহেন উদ্ভ্রান্ত মূর্তি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল হেন্ডারসন। বলেছিল সাগ্রহে, দেখেছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা কী?
–দেখে এলাম জিনিসটাকে।
–কোথায় দেখলে?
–হর্সেল কমনে পড়ে আছে।
চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে হেন্ডারসনের। কোদাল ফেলে দিয়ে বলেছিল রুদ্ধশ্বাসে, উল্কাপিণ্ড! বল কী? চল, চল, দেখে আসা যাক। দৌড়াল দুজনে কমন প্রান্তরের দিকে। যেতে যেতে ওগিলভি হেন্ডারসনকে বললে যা যা দেখেছে এবং শুনেছে।
কথা বলতে বলতেই পৌঁছে গেল উঁচু টিলার ওপর। ওই তো পড়ে রয়েছে মহাকায়। চোঙা। একইভাবে হেলে বেশ খানিকটা গেঁথে গেছে জমির মধ্যে। ধোঁয়ার ফিকে রেশ দেখা যাচ্ছে এখনও। কিন্তু..
ডালাটা প্রায় খুলে এসেছে। সেই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে একটা সোঁ সোঁ শব্দ। যেন হাওয়া ঢুকছে ভেতরে… অথবা বেরিয়ে আসছে বাইরে।
কাছে এগিয়ে গিয়েছিল দুই মূর্তিমান। চোঙার ধাতব দেহে লাঠি ঠুকেছিল ঠনঠন শব্দে। কিন্তু কোনও সাড়াই আসেনি ভেতর থেকে।
গুম হয়ে গিয়েছিল ওগিলভি। বলেছিল চিৎকার করে, ভেতরে যারা আছ, চুপটি করে বসে থাক। আরও লোকজন নিয়ে আসছি।
হেন্ডারসন বলেছিল, বেচারা! ঠান্ডায় জমে গেছে, এমনও হতে পারে।
ঠান্ডায় জমুক আর গরমেই মরুক, নিজেদের দ্বারা আর কিছু সম্ভব নয় দেখে হেন্ডারসন আর ওগিলভি ফিরে এসেছিল শহরে–আরও লোকজন জোটানর আশায়। কোদাল-শাবল নিয়ে আসতে হবে প্রত্যেককে।
হেন্ডারসন তখন ভাবছে। এমন জবর খবরটা আগে পাঠানো দরকার নিজের খবরের কাগজে। তাই আগে টেলিগ্রামে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে দিল সম্পাদককে।
খবরটা যেন হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল। খবরের কাগজ কিনতে হকারের কাছে গিয়েছিলাম আমি–চোঙা-সংবাদ শুনলাম তখনই।
কাগজের হকারই বললে, শুনেছেন? তাজা খবর! মঙ্গল গ্রহ থেকে মানুষ এসেছে। বেশি দূরে নয়–ওই কমনে?
অসম্ভব! বলেছিলাম আমি।
বলা বাহুল্য, বিলক্ষণ চমকে গিয়েছিলাম খবরটা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়েছিলাম নিজের চোখে দেখবার জন্যে। চোঙার চারধারের উঁচু টিলায় ততক্ষণে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। মজা দেখছে। কিছু লোক নেমে পড়েছে গর্তে। গাঁইতি-শাবল দিয়ে চাড় মারছে চোঙার তলায়। অদ্ভুত ধূসর রঙের অজানা ধাতু দিয়ে তৈরি বিশাল সিলিন্ডারটার দিকে চেয়ে ছিলাম আমি ভয়বিহ্বল চোখে।