মরেছে প্রত্যেকেই–কীভাবে তা জানি না। কিন্তু প্রাণ নেই কোনও মঙ্গলগ্রহীর দেহেই!
ভেবেচিন্তে কারণ অবশ্য পরে বার করেছিলাম। ঈশ্বর আছেন কি নেই, সে প্রমাণও পেয়েছিলাম। ঈশ্বরই ক্ষুদ্রতম প্রাণীদের বাসস্থান বানিয়েছেন এই পৃথিবীকে। ক্ষুদ্রতম এই প্রাণীদের নাম জীবাণু! তাদের কেউ কেউ মানুষের বন্ধু–কিন্তু রোগজীবাণুরা মানুষের পরম শত্রু। মানুষ তাদের সঙ্গে সহাবস্থান করেছে–মানুষের শরীর রোগজীবাণুদের আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখবার প্রতিরোধব্যবস্থা লক্ষ লক্ষ বছরের ক্রমবিবর্তনে আপনা থেকেই গড়ে নিয়েছে।
কিন্তু মঙ্গল গ্রহে তো জীবাণু নেই! শুধু চোখে যাদের দেখা যায় না, অথচ যারা শরীরের ওপর চড়াও হলে ত্রাহি ত্রাহি রব ছাড়তে হয়–তাদের জন্যে প্রস্তুত ছিল না মঙ্গল গ্রহের প্রাণীরা। মঙ্গল গ্রহে যদি জীবাণু থাকত, জীবাণুর আক্রমণ সয়ে টিকে থাকবার প্রতিরোধব্যবস্থাও তাদের শরীরে থাকত।
ফলে, পৃথিবীতে পা দিতে-না-দিতে অদৃশ্য জীবাণুরা চড়াও হয়েছে তাদের দেহে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে গেছে। মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করেছে এবং খতম করে দিয়েছে। মঙ্গলগ্রহীদের। জীবাণু আক্রমণ ঠেকানোর কৌশল মানুষ রপ্ত করার আগে মানুষকেও এইভাবে মরতে হয়েছে অদৃশ্য শত্রুদের আক্রমণে। এবার প্রাণবলি দিল আগন্তুক ভিনগ্রহী হানাদাররা!
অদৃশ্য শত্রুর প্রতাপ বুঝে গেল হাড়ে হাড়ে! মাইক্রোস্কোপ ছাড়া যাদের দেখা যায় না যাদের কামান-গোলাবারুদ কিছুই নেই–তাদেরই নীরব অমোঘ আক্রমণ ঠেকাতে পারল না দুর্ধর্ষ দুর্জয় মঙ্গল গ্রহের প্রাণীরা।
ঈশ্বর! তুমি আছ! অবশ্যই আছ!
টেলিগ্রাফ মারফত চকিতে সুসংবাদটা ছড়িয়ে গেল সারা দুনিয়ায়। গির্জায় গির্জায়। নিনাদিত হল ঘণ্টা। সারা ইংল্যান্ড নেচে উঠল খুশির আনন্দে।
আমি তখন কী করছিলাম? ট্রেন ধরে যারা বাড়ি ফিরে আসছিল, তাদের সঙ্গে একটা ট্রেনে উঠে বসেছিলাম। কু-ঝিকঝিক শব্দে বিপুল উল্লাসে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ট্রেন ছুটে গিয়েছিল মাঠ-বন-প্রান্তর পেরিয়ে, পাইন আর পাহাড়ের পাশ দিয়ে।
ফিরে এসেছিলাম আমার সুখের কুঞ্জ-নিভৃত গৃহে।
দূর থেকে পাহাড়ে উঠতে উঠতে সজলনয়নে চেয়ে ছিলাম অটুট বাড়িটার দিকে। নির্মম মঙ্গলগ্রহীরা যে কারণেই হোক তাণ্ডবনৃত্য করে যায়নি এদিকে। চিমনিটাই শুধু ভেঙেছে– তার বেশি কিছু নয়।
বাড়ির কাছে এসে দেখেছিলাম, পড়বার ঘরের জানলা যেভাবে খুলে রেখে পলায়ন করেছিলাম–সেইভাবেই খোলা রয়েছে। কাদা-মাখা পায়ে সদর দরজা পেরিয়ে ওপরতলায় উঠেছিলাম–এখনও সেই পায়ের ছাপ হলঘর পেরিয়ে সিঁড়ির ওপর দিয়ে চাতালে উঠে গেছে। শুকনো পায়ের ছাপের পেছন পেছন ভারী মন নিয়ে উঠে এসেছিলাম ওপরতলায়। টেবিলের ওপর দেখেছিলাম, খাতাবই যেভাবে খুলে রেখে গিয়েছিলাম, সেইভাবেই ভোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
বিষণ্ণ মনে নেমে এসেছিলাম নিচের তলায়। না, কেউ নেই সেখানেও। স্ত্রী হয়তো আমার অবর্তমানে ফিরে এসেছে বাড়িতে–অতি ক্ষীণ এই আশাটাও উধাও হয়ে গেল মন থেকে শূন্য গৃহ স্বচক্ষে দেখবার পর।
তারপরেই ঘটল একটা অদ্ভুত ঘটনা।
অস্পষ্ট খেদোক্তি ভেসে এল কানে-বৃথা চেষ্টা। কেউ নেই। কেউ ফেরেনি!
চমকে উঠেছিলাম। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছিল ললাটে। এ কার কণ্ঠ? অতলান্ত দুঃখ কি মুখ দিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছি? বিষাদের পাহাড় সরব হয়েছে নিজেরই কণ্ঠস্বরে?
সবেগে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখেছিলাম, খোলা রয়েছে পেছনের গরাদবিহীন জানলা। কথাগুলো ভেসে এসেছে ওই জানলা দিয়েই!
পরমুহূর্তেই চৌকাঠে আবির্ভূত হল আমার স্ত্রী আর ভায়েরা।
স্তম্ভিত আমরা সকলেই। নির্বাক! নিশ্চুপ! চেয়ে আছি পরস্পরের মুখের দিকে!
তারপরেই বিষম আবেগে দৌড়ে এসেছিল আমার স্ত্রী–ভেঙে পড়েছিল কান্নায়, আমি জানতাম। আমি জানতাম!
এ কাহিনির সবচেয়ে বড় বিস্ময়কর ঘটনা এইটাই। আমরা দুজনেই ভেবেছিলাম, কেউ আর বেঁচে নেই। স্ত্রী হারিয়েছে আমাকে আমি হারিয়েছি স্ত্রী-কে–জন্মের মতো!
তাই বুঝি দয়ালু ঈশ্বর শেষ চমকটা দিয়ে গেলেন এইভাবে।
তারপর বহু সন্ধ্যা আমরা দুজনে পড়বার ঘরে বসে গল্পগুজব করেছি, কখনও আমি লেখা নিয়ে আর আমার স্ত্রী বোনা নিয়ে তন্ময় থেকেছে–কেউ কারও সঙ্গে কথা বলিনি। আমার মনের মধ্যে মাঝেমধ্যেই কিন্তু গুঞ্জরিত হয়েছে একটা মহা আশঙ্কা
মঙ্গলগ্রহীরা সুদূর মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীতে হানা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে, অন্য গ্রহ থেকে এমনি হানাদাররা পৃথিবীতে এলেও আসতে পারে ভবিষ্যতে।
আমরা কি তার জন্যে তৈরি?
————
[অনুবাদক:
অরসন ওয়েলস মারা গেলেন
গল্পটা প্রথমে শুনেছিলাম সত্যজিৎ রায়ের কাছে আকাশবাণীতে সাহিত্যবাসরে বারোয়ারি গল্পপাঠের আসরে।
গোটা যুক্তরাষ্ট্রে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। গণ-আতঙ্ক! বাড়িঘর ছেড়ে মানুষ পালাচ্ছে, ছেলেমেয়েদের ঠেলেঠুলে তুলে দিচ্ছে গাড়িতে, মঙ্গলগ্রহীদের খপ্পর থেকে প্রাণ বাঁচাতে পাগলের মতো হাঁকাচ্ছে গাড়ি। রাস্তাঘাটে বেগে ধেয়ে যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স। বিষ-গ্যাস থেকে বাঁচবার জন্যে নাকে-মুখে ভিজে তোয়ালে জড়িয়ে নিয়েছে প্রত্যেকেই।
সত্যিই কি মঙ্গল গ্রহের বিভীষিকারা হানা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে?