হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল মাথায়। এক টুকরো কয়লা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলাম একদিকে। ঠকাস করে কয়লা গিয়ে পড়ল যেখানে, বিদ্যুৎবেগে শুড়টা ধেয়ে গেল সেদিকে। চক্ষের নিমেষে কয়লাটাকে সাপটে ধরেই সাঁত করে বেরিয়ে গেল বাইরে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা! অখণ্ড নৈঃশব্দ্য নেমে এল কয়লাঘরে!
না, শয়তানসদৃশ সেই শুড় আর হানা দেয়নি কয়লাঘরে। কিন্তু মনে সাহস ফিরিয়ে আনতে পারিনি আমি পুরো একটা দিন। নিঃসাড়ে পড়ে ছিলাম অন্ধকারে কয়লার গাদায়– তেষ্টায় বুক ফেটে গেলেও নড়বার সাহস হয়নি।
তারপর অবশ্য আর পারিনি। তৃষ্ণা সইতে না পেরে পা টিপে টিপে বেরিয়েছিলাম জলের খোঁজে। গুটিগুটি এসেছিলাম ফাটলটার কাছে…
বাইরে কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি। যে গর্তের মধ্যে গেঁথে রয়েছে চোঙাটা, যেখানে গত আট দিন ধরে ব্যস্তসমস্ত থেকেছে মঙ্গল গ্রহের আততায়ীরা–আজ সে গর্ত বেবাক শূন্য। কেউ নেই! কেউ নেই!
হাঁচোড়-পাঁচোড় করে বেরিয়ে এসেছিলাম গর্তের মধ্যে। গুটিগুটি উঠে এসেছিলাম গর্তের ওপরে।
দেখেছিলাম ভারী উজ্জ্বল দিনের আলো। আর নীল… ঘন নীল আকাশ। আঃ! কী স্বস্তি! মঙ্গলগ্রহী বিকটদের টিকিও দেখা যাচ্ছে না ধারেকাছে! দূরে দূরে খাড়া আধভাঙা বাড়ি আর গির্জা। প্রাণের সাড়া নেই কোথাও!
শ্মশান শহরের পথ বেয়ে চারদিকের ভগ্নস্তূপ দেখতে দেখতে ম্লানমুখে অবশ দেহে রওনা হয়েছিলাম লন্ডন শহরের দিকে। যেতে যেতে অম্বেষণ করে গেছি খাদ্য–পেট যে জ্বলে যাচ্ছে। অনাহারে যে আধমরা হয়ে গেছি। বলতে লজ্জা নেই, যেখানে যেটুকু খাবার পেয়েছি, তা-ই খেয়েছি। শরীরে বল পেয়েছি। আবার হেঁটেছি–চোরের মতো–ভয়ে ভয়ে!
আচমকা একটা বেড়ালকে দরজা টপকে পালাতে দেখেছিলাম। বেচারা! মানুষ দেখে আঁতকে উঠছে।
তারপরেই একইভাবে উধাও হতে দেখলাম একটা ধেড়ে ইঁদুরকে।
সন্ত্রস্ত ভীত উৎকণ্ঠিত পৃথিবীর ইতর প্রাণীরাও। আমিও তো ঠিক এইভাবেই দিন কাটিয়েছি কয়লাঘরের অন্ধকারে। কয়লা চাপা দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালিয়ে গেছি হাস্যকরভাবে। বেড়াল আর ইঁদুরটার চকিত পলায়ন দেখে এই শিক্ষাই নিলাম আমি। ঠিক। ওদের মতোই, বেড়াল আর ইঁদুরের মতো আনাচকানাচে লুকিয়ে এখন থেকে প্রাণ বাঁচাতে হবে আমাকে। আওয়াজ শুনলেই সটকান দিতে হবে–আড়ালে লুকিয়ে শত্রুর চোখ এড়িয়ে যেতে হবে। শত্রু এখানে মঙ্গল গ্রহের বিদঘুটে প্রাণীরা, প্রথম দর্শনে যাদের একান্ত অসহায় মনে করেছিলাম, তারাই এখন বীরদর্পে বিচরণ করছে পৃথিবীর বুকে–পৃথিবীর মালিক তো এখন থেকে ওরাই। আমরা হেরে গেছি–পালিয়ে আর লুকিয়ে প্রাণে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোনও গতি নেই আমাদের।
ভাঙা শহর, গ্রাম, কারখানা দেখতে দেখতে আর টলতে টলতে এইভাবেই হাঁটলাম পুরো দুটো দিন, খাবার যা পেয়েছিলাম তা পর্যাপ্ত নয়। পেট ভরেনি–অবসাদও কাটেনি। তবুও হেঁটেছি মনের জোরে। স্রেফ মনের জোরে–আর দুচোখ দিয়ে দেখে গেছি বর্ণনার অতীত ধ্বংসদৃশ্য। শ্মশান! শ্মশান! শ্মশান হয়ে গেছে এই পৃথিবী।
লন্ডনে পৌঁছেও দেখলাম মহাশ্মশান। সদাচঞ্চল কর্মব্যস্ত প্রাণস্পন্দনে ভরপুর লন্ডন শহর একেবারে মরে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। নির্জন পথঘাটে একা একা হেঁটেছি আর নিঃশব্দে কেঁদেছি। মানুষ নেই… মানুষ নেই–এ পৃথিবীতে আর বুঝি জীবিত মানুষ নেই–একা আমি শুধু বেঁচে আছি হৃদয়বিদারক এই দৃশ্য দেখবার জন্যে।
সাউথ কেনসিংটনের কাছাকাছি আসতেই সেই প্রথম শুনতে পেলাম একটা অপার্থিব হাহাকার–উহ-লা! উহলা উহ-লা!
এ আবার কীসের আর্তনাদ? এরকম বিকট অথচ করুণ আর্ত-চিৎকার তো কখনও শুনিনি। অমানবিক কণ্ঠে কে এমনভাবে চেঁচিয়ে চলেছে মরা নগরীর বুকে? প্রেতপুরীর বিকটোল্লাসও বুঝি এমন গা হিম-করা নয়।
থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি। উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে ছিলাম এদিকে
সেদিকে কাছে-দূরে–কিন্তু কাউকে দেখিনি–একাকী অমন কে অমানুষিক আর্তনাদ করে চলেছে, বুঝতেও পারিনি।
ফলে আবার সীমাহীন আতঙ্ক পেয়ে বসল আমাকে। দৌড়ালাম উন্মাদের মতো দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে। কোথায় যাচ্ছি, কীভাবে যাচ্ছি–কোনও খেয়াল আর রইল না।
আচমকা দেখতে পেলাম একটা যন্ত্রদানবকে! আতীক্ষ্ণ আর্তনাদটা বেরচ্ছে তারই মাথার বাক্স থেকে–উহ-লা! উহ-লা! উহ্-লা!
সহসা স্তব্ধ হল আর্ত-চিৎকার। থমথমে নৈঃশব্দ্য নেমে এল মৃত্যুপুরীতে। সে যে কী বিপুল শব্দহীনতা তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। অকস্মাৎ বজ্রপাত চেতনার ঝুঁটি পর্যন্ত যেভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়–অকস্মাৎ এই শব্দহীনতাকে শুধু তার সঙ্গেই তুলনা করা চলে।
আমি স্তম্ভিত। অবশ। বিমূঢ়।
বিশালদেহী যন্ত্রদানব টলমল করে উঠেই প্রচণ্ড শব্দে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ভাঙা ঘরবাড়ির ওপর। নিস্তব্ধ শহর শিউরে উঠল সেই শব্দে।
শিহরিত হলাম আমিও। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। তারপরেই পাগলের মতো দৌড়েছিলাম ভূলুষ্ঠিত নিস্পন্দ তেপায়া দানবের দিকে।
কাছে গিয়ে দেখেছিলাম, বাক্সের ঢাকনা খুলে গেছে বিকটাকার মঙ্গলগ্রহীদের অবর্ণনীয় কুৎসিত দেহগুলো দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু কেউ নড়ছে না। এক্কেবারে নিষ্প্রাণ!
পাশের ছোট টিলাটায় উঠে গিয়েছিলাম হুড়মুড়িয়ে। সেখান থেকে দেখেছিলাম শুধু মড়া আর মড়া! সবই মঙ্গলগ্রহীদের! হেথায়-সেথায় প্রায় গোটা পঞ্চাশেক যন্ত্রদানব হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। প্রতিটার মাথার বাক্সের ঢাকনি খুলে গেছে। কিলবিলিয়ে মঙ্গলগ্রহীরা বেরিয়ে এসেছে–কিন্তু নড়ছে না কেউই।