ভয়ের চোটে চেঁচিয়ে কথা বলতেও পারিনি। চাপা গলায় ধমক দিয়েছিলাম, চুপ! একদম নড়বেন না। বাইরেই রয়েছে ওরা–টের পাচ্ছেন?…
পাদরি টের পাক আর না-পাক, হাড়ে হাড়ে আমি টের পেয়েছিলাম, মঙ্গলগ্রহীদের কদাকার অস্তিত্ব রয়েছে অতি সন্নিকটে। ব্যাপারটা কী ঘটে গেল, তা-ও আঁচ করে নিয়েছিলাম। আর-একটা চোঙা মঙ্গল গ্রহ থেকে উড়ে এসে আছড়ে পড়ল বাড়ির খুব কাছেই। সাঁই সাঁই করে উড়ে যাওয়ার সময়ে এ বাড়িরও দফারফা করে দিয়ে গেছে, জিনিসপত্র আস্ত নেই কিছুই। কড়িকাঠ হেলে পড়েছে। দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। প্রাণে যে বেঁচে আছি এখনও এইটাই আশ্চর্য।
সকাল না-হওয়া পর্যন্ত আঙুল নাড়বার সাহসও পেলাম না। তারপর অতি সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে গেলাম ভাঙা দেওয়ালের একটা ফুটোর কাছে। ফুটো দিয়ে বাইরে তাকাতেই ছলাত করে উঠল বুকের রক্ত।
বিকটদেহী অতিশয় কদাকার একটা মঙ্গলগ্রহী জ্বলন্ত চোখে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে সদ্য অবতীর্ণ বিশাল সিলিন্ডারটাকে।
পঞ্চম সিলিন্ডার। যা ভেবেছিলাম, ঠিক তা-ই। পঞ্চম চোঙা উল্কাবেগে ধেয়ে এসে তেরচাভাবে এই বাড়ির বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেঁথে গেছে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে। ভগ্নগৃহের নিচে কবরস্থ হতে চলেছি আমরাও!
অস্ফুট কাতরানি শুনলাম কানের কাছে পাদরির ভাঙা গলায়–হা ঈশ্বর! রক্ষে কর!
আর ঈশ্বর! ঈশ্বর আছেন কি নেই–এই সন্দেহটাই সেই মুহূর্তে দেখা দিয়েছিল মনের মধ্যে। এ কী অনাচার! অকারণে ভিনগ্রহীদের এ কী অত্যাচার! একটার পর একটা চোঙা নামিয়ে চলেছে শ্যামল সবুজ পৃথিবীর বুকে–তারপরেই তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে নিরীহ মানুষগুলোর ওপর। ঈশ্বর! তুমি কি সত্যিই আছ?
ঈশ্বর যে আছেন, সব দেখছেন এবং দণ্ড দেওয়ার আয়োজন করে চলেছেন–তা বুঝেছিলাম পরে।
তখন কিন্তু আতঙ্কে বিবশ হয়ে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারিনি। সে যে কী কষ্ট, তা আমি কোনওদিনই লিখে বোঝাতে পারব না… পারব না… পারব না!
অনেক… অনেকক্ষণ পরে খিদের জ্বালা অনুভব করেছিলাম নাড়িতে… বত্রিশ নাড়ি মোচড় দিয়ে উঠতেই আতঙ্কের নাগপাশ খসিয়ে গুটিগুটি খুঁজে বার করেছিলাম রান্নাঘর। সে ঘরের ভগ্নদশাও চোখে জল এনে দেয়। প্রকাণ্ড চোঙার এক ধাক্কাতেই পুরো বাড়িটাই বসে গেছে মাটির মধ্যে। খুঁজেপেতে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে খাবার খেতে খেতে ফাটল দিয়ে দেখে গেলাম, শয়তানের চেলার মতো কুৎসিতদর্শন মঙ্গল গ্রহের প্রাণীগুলো কীভাবে বানিয়ে চলেছে নারকীয় মেশিনের পর মেশিন। ওইরকম জড়ভরত শরীর নিয়ে এত দ্রুতও কাজ করতে পারে শয়তানগুলো। সারাদিন ধরে কাজই করছে-বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই–একনাগাড়ে খেটে দেখতে দেখতে খাড়া করে ফেলছে একশো ফুট উঁচু যন্ত্রদানবদের।
পাতালঘরে এইভাবে অসীম উৎকণ্ঠা আর যন্ত্রণা সহ্য করে দীর্ঘ আট দিন আট রাত কাটানোর পর নবম দিনে আচমকা একটা শব্দ শুনে দিবানিদ্রা ছুটে গেল আমার। ধড়মড় করে উঠে পড়ে দেখলাম, পাদরি মড়ার মতো পড়ে আছে ভূমিশয্যায়–আর একটা কিলবিলে শুড়-ভাঙা কড়িবরগার ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে ঘরের মধ্যে!
চাচা আপন প্রাণ বাঁচা নীতি অনুসরণ করেছিলেন তৎক্ষণাৎ। সুট করে সরে গিয়েছিলাম শুড়ের নাগালের বাইরে–ঘাপটি মেরে ছিলাম কয়লা রাখার ঘরে–নিবিড় তমিস্রার মধ্যে। ধড়াস ধড়াস করছিল উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে যাওয়া হৎপিণ্ডখানা–জানি না হতচ্ছাড়া মঙ্গলগ্রহী আমাকেও দেখে ফেলেছে কি না। যদি দেখে থাকে…
আর ভাবতে পারিনি! সমস্ত অণু-পরমাণুর মধ্যে প্রবিষ্ট নিদারুণ আতঙ্ক আমার প্রাণপ্রদীপ সেই মুহূর্তে কেন যে নিবিয়ে দেয়নি–আজও তা ভেবে অবাক হয়ে যাই।
অন্ধকায়ে গা ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে প্রথমে কিছু দেখতে পাইনি। কানে ভেসে এসেছিল শুধু টুক টুক টুক করে টোকা মারার শব্দ… তারপর শুনলাম, হিড়হিড় করে ভাঙা জিনিসপত্রের ওপর দিয়ে কী যেন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাহসে বুক বেঁধে উঠে গিয়েছিলাম রান্নাঘরে। ফাটল দিয়ে উঁকি মারতেই শিউরে উঠেছিলাম।
বেচারা পাদরি! শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে মঙ্গল গ্রহী তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের মধ্যে থেকে।
আঁতকে উঠে পিছু হটে এসেছিলাম কয়লা ঘরের মধ্যে। কয়লা তুলে নিজের গায়ে রেখে আত্মগোপন করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলাম প্রাণপণে।
ওই অবস্থাতেই শুনলাম নতুন একটা শব্দ। কয়লাঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছিলাম নিজের হাতে। মঙ্গল গ্রহের প্রাণী দরজার হাতল ধরে মোচড় দিচ্ছে।
উঃ! সে কী মনের অবস্থা আমার। অন্ধকারে চোখ সয়ে গিয়েছিল বলেই দেখতে পেলাম, হাতলটা ঘুরে যাচ্ছে একটু একটু করে। তারপরেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শুড়ের ঠেলায় খুলে গেল পাল্লা। ফাঁক দিয়ে কিলবিলিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল কুটিল সর্পের মতো শুড়খানা!
এবং এগিয়ে এল আমার দিকেই! ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে ছিটকে সরে গিয়েছিলাম আমি যতখানি তফাতে সরা যায়। কিন্তু ছোট ঘরে এমনিতেই জায়গা নেই–দেওয়ালে পিঠ দিয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলাম আধমরার মতো নিস্পন্দ দেহে।
কিলবিলে শুঁড়টা এগিয়ে এল মেঝের ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে, ছুঁয়ে রইল আমার বুটের ডগা। পাছে আর্ত-চিৎকার বেরিয়ে যায় গলা চিরে, তাই প্রাণপণে আঙুল কামড়ে ধরলাম। হিমেল জঘন্য ওই শুড় যদি আর-একটু এগোয়… অথবা পা সমেত বুটটাকে পাকিয়ে ধরে!