পাদরি সাহেব দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রয়েছে এক কোণে। বকবক করেছে অনেকক্ষণ। কাঁহাতক আর মুখের গ্যাঁজলা উঠিয়ে চেঁচাবে? ঝিমিয়ে পড়েছে সেই কারণেই। আমি কিন্তু দাঁড়িয়ে আছি। ক্লান্ত চরণে ঘুরঘুর করছি। পরিত্যক্ত বাড়িটাকেই দুর্গ বানিয়ে বাঁচবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তখনও নিশার অবসান ঘটেনি। রাতের তারা বিদায় নেয়নি। জানলা থেকে উঁকি মেরে কিন্তু দেখলাম, কালো ধোঁয়ার ছিটেফোঁটাও আর নেই কোথাও। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে অবলীলাক্রমে ছড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষদের নিকৃষ্ট কীটের মতোই যারা নিঃশেষে যমালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে, মৃত্যুরূপী কালো ধোঁয়ার অপসারণ ঘটিয়েছে তারাই গরম বাষ্পর পিচকিরি দিয়ে। তাজ্জব প্রাণী বটে! বিষ-ধোঁয়া ছাড়বারই বা কী দরকার ছিল –আবার তাকে ধুয়ে দিয়ে মেদিনীকে নির্মল করারই বা কী প্রয়োজন ছিল!
ওই সময়ে অবশ্য এত কথা আমি ভাবিনি। ভাববার মতো অবসর বা মনের অবস্থা ছিল না। যেই দেখলাম বিষ ধোঁয়ার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও, অমনি বললাম পাদরিকে, এই সুযোগ! এবার বেরিয়ে পড়া যাক!
আঁৎকে উঠল বৃদ্ধ পাদরি; না! না! এখানেই বেশ আছি।
কিন্তু আমি তো জানি, যেতে আমাকে হবেই। এ জায়গা এই মুহূর্তে যত নিরাপদই হোক-না কেন, অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা জানি না। তা ছাড়া, আমাকে যেতে হবে স্ত্রী র খোঁজে। সে বেচারার কী হাল হল, না-জানা পর্যন্ত স্বস্তি নেই আমার।
সুতরাং পাদরিকে আমার অভিপ্রায় জানিয়ে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে এলাম ভাঙাচোরা বাড়ির বাইরে। পেছন পেছন দৌড়ে এল পাদরি সাহেব। একা একা এই নরকপুরীতে থাকতে সে রাজি নয়।
কিছু দূর গিয়েই কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম বিষম ভয়ে!
রাস্তা বেয়ে লোকজন পালাচ্ছে ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু পলায়মান জনতার মাথার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে একশো ফুট উঁচু একটা যন্ত্রদানবকে। নির্বিকারভাবে চলেছে হনহন করে। যেন এ পৃথিবীটা তাদেরই। মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসেছে। এখন হাওয়া খেতে বেরিয়েছে।
খটকা লাগল একটু পরেই।
তাপরশ্মি বর্ষণ করছে না কেন ভীমাকার যন্ত্রদানব? লোকজন প্রাণভয়ে ছুটছে তো তার সামনে দিয়েই। লম্বা লম্বা পাইন গাছের মধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে সেদিকেই নজর রেখেছে করাল আকৃতিটা–অথচ তাপরশ্মি ছুঁড়ে নিকেশ করে দিচ্ছে না কাউকেই!
ব্যাপারটা কী?
ব্যাপারটা যে কী ভয়ানক, তা অচিরেই দেখতে পেলাম স্বচক্ষে এবং শিউরে উঠলাম যন্ত্রদানবদের এহেন আচরণের মূল উদ্দেশ্যটা অনুধাবন করতে না পেরে!
পলায়মান জনতাদের মধ্যে থেকে একটা একটা করে লোককে খপ করে শুড়ের ডগায় তুলে নিচ্ছে যন্ত্রদানব এবং নিক্ষেপ করছে পিঠের ধাতু-খাঁচায়!
কেন? না মেরে জ্যান্ত মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে কেন? জবাবটা জেনেছিলাম পরে এবং তা এমনই নারকীয় ব্যাপার যে, লিখতে আমার কলম সরছে না। মানুষ জাতটা খাবার খেতে যে সময়টা নষ্ট করে, মঙ্গল গ্রহের প্রাণীরা তা-ও করে না। তারা জ্যান্ত মানুষের রক্ত টেনে নিয়ে নিজেদের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়। বাকি সময়টা শুধু কাজ করে যায়।
টপাটপ করে তোক তুলে পরিত্রাহি চিৎকার সত্ত্বেও খাঁচার মধ্যে ফেলছে দেখেই কিন্তু বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল আমার হাতে-পায়ে। পাঁইপাঁই করে দৌড় দিয়েছিলাম পেছন ফিরেই। কোথায় যাচ্ছি, পথে কী আছে–অত দেখিনি। অন্ধকারে দেখা সম্ভবও ছিল না। ফলে, ঝপাত করে দুজনেই ঠিকরে পড়লাম একটা খানার মধ্যে।
তখন শেষ রাত। রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে খানার জলেই ঘাপটি মেরে থাকা সমীচীন বোধ করলাম–এর চাইতে নিরাপদ জায়গা আপাতত বাইরে আর কোথাও নেই। গাঢ় তমিস্রায় কিছু দেখতে পাচ্ছি না ঠিকই কিন্তু সেইটাই তো আমাদের পরম নিরাপত্তা। হতচ্ছাড়া যন্ত্রদানবরাও তো দেখতে পাবে না জলজ্যান্ত এই দুটো মানুষকে।
অনেকক্ষণ পরে হট্টগোল থেমে যাবার পর গুটিগুটি বেরিয়ে এলাম খানার মধ্যে থেকে। রাস্তা এড়িয়ে গেলাম। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পা টিপে টিপে এগলাম। বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল প্রতি পদক্ষেপে।
খিদে পেয়েছিল খুবই। সামনে একটা খালি বাড়ি দেখে ঢুকে পড়লাম তার মধ্যে। তেষ্টাও পেয়েছে বিলক্ষণ। হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গায় পেলাম রুটি আর শূকর মাংস। পাদরি পেয়ে গেল তৃষ্ণানিবারণের জল।
পরমানন্দে খাওয়াদাওয়া করছি দুই পলাতক পৃথিবীবাসী, আচম্বিতে এ কী কাণ্ড! চোখ ধাঁধিয়ে গেল অতি তীব্র সবুজ দ্যুতিতে–আলোর ঝলক নেমে এল আকাশ থেকে–নিমেষে দূরীভূত করল ভাঙা ঘরের প্রতিটি কোণের তমিস্রাপুঞ্জ। পরক্ষণেই শুনলাম পিলে-চমকানো একটা বিস্ফোরণের শব্দ। সে কী ভয়াবহ আওয়াজ। কানের পরদা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো অনেক ভয়ংকর বিকট আওয়াজ শুনেছি এই জীবনে, কিন্তু এরকম হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ করা নিনাদ তো কখনও শুনিনি! গায়ের প্রতিটা লোম খাড়া হয়ে গেল রক্ত ছলকে দেওয়া সেই বিপুল সংঘাত-শব্দে। ছিটকে গেলাম শূন্যে–ছিটকে গেল সবকিছুই।
বলা বাহুল্য, সংবিৎ হারিয়েছিলাম আচমকা সেই প্রলয়কাণ্ডে। জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলাম কতক্ষণ পরে, তা বলতে পারব না। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি। তমালকালো আঁধারে মেঝের ওপর ছিটকে পড়ে আছি আমি। পাশের দিকে কাতরানি শুনে বুঝলাম, ঘোর কাটিয়ে উঠেছে পাদরিসাহেবও।