“সে তো অবিবাহিতও হতে পারে।”
“না। সে বাড়িতে একটা হাঁস নিয়ে যাচ্ছিল স্ত্রীকে তুষ্ট করতে। হাঁসের পায়ের কার্ডটায় কী লেখা ছিল মনে করে দ্যাখো।”
“হুম! তোমার কাছে দেখছি সব কিছুরই উত্তর আছে। কিন্তু কী করে বুঝলে লোকটার ঘরে গ্যাসের আলো নেই?”
“টুপিতে একটা-দুটো ট্যালোর[†] দাগ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু দ্যাখো পাঁচ-পাঁচটা দাগ। এ থেকে নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায়, লোকটা খুব ঘন ঘন ট্যালো জ্বালে। রাতের অন্ধকারে এক হাতে টুপি আর অন্য হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি ধরে উপরে ওঠে। গ্যাসজেট থেকে ট্যালোর দাগ পড়ে না। কি, মিলছে তো?”
আমি হেসে বললাম, “নিঃসন্দেহে অসামান্য তোমার পর্যবেক্ষণ শক্তি! কিন্তু তুমি বলছো, কোনো অপরাধের ঘটনা ঘটেনি। একটা হাঁস খোয়া-যাওয়া ছাড়া কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। তাহলে আর এই সব পাঁচ-সাত ভেবে মাথা খারাপ করছো কেন হে?”
হোমস একটা কী বলার জন্য মুখ খুলেছিল। কিন্তু এমন সময় দড়াম করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এল কমিশনেয়ার পিটারসন। তার চোখমুখ লাল। একটা হতভম্ব ভাব।
“মিস্টার হোমস, ওই হাঁসটা! ওই হাঁসটা, মশায়!” সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
“অ্যাঁ? কী হয়েছে ওই হাঁসটা? ওটা কী আবার জ্যান্ত হয়ে উঠে ডানা মেলে জানলা দিয়ে উড়ে পালিয়ে গেছে?” উত্তেজিত লোকটার মুখটা ভাল করে দেখার জন্য সোফায় বসেই শরীরটাকে মোচড় দিল।
“না মশায় না! দেখুন, আমার বউ ওই হাঁসটার পেট থেকে কী পেয়েছে!” এই বলে পিটারসন নিজের হাতটা মেলে ধরল। একটা জ্বলজ্বলে নীল পাথর। মটরশুঁটির দানার চেয়েও ছোটো। কিন্তু এত চকচকে যে মনে হচ্ছিল পিটারসনের হাত থেকে বিজলি আলো ঠিকরাচ্ছে।
একটা শিস দিয়ে উঠে বসল হোমস। “বাই জোভ, পিটারসন! তুমি যে গুপ্তধন পেয়েছো হে। জিনিসটা কী জানো তো?”
“মশায়, এটা কী হিরে? হিরে তো খুব দামি পাথর। কাঁচ কাটা যায়।”
“এটা যে-সে দামি পাথর নয়। এটা হল সবচেয়ে দামি পাথর।”
আমি বলে ফেললাম, “কাউন্টেস অফ মরকারের নীল পদ্মরাগ নয় তো!”
“হ্যাঁ, সেটাই। এটা কেমন দেখতে তা আমার আগেই জানা ছিল। ‘দ্য টাইমস’-এ প্রায়ই এটার সম্পর্কে একটা বিজ্ঞাপন বেরোচ্ছে। আশ্চর্য পাথর এটা। এর আসল দাম শুধুই অনুমান করা যায়। এটার উপর ১০০০ পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সেটা এর আসল দামের যে কুড়ি ভাগের এক ভাগও নয়, তা বলাই যায়।”
“এক হাজার পাউন্ড! হা ভগবান!” কমিশনেয়ার ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তারপর আমাদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল।
“হ্যাঁ, এক হাজার পাউন্ড। আমার মনে হয় এটার সঙ্গে কাউন্টেসের কিছু অমূল্য মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এটা ফিরে পাওয়ার জন্য উনি অর্ধেক সম্পত্তি হাতছাড়া করতেও অরাজি হবেন না।”
আমি বললাম, “যতদূর মনে পড়ছে, এটা হোটেল কসমোপলিটান থেকে খোয়া গিয়েছিল।”
“ঠিক বলেছো। বাইশে ডিসেম্বরের ঘটনা। ঠিক পাঁচ দিন আগে। কলের মিস্ত্রি জন হরনারকে গ্রেফতার করা হয় লেডির গয়নার বাক্স থেকে এটা সরানোর অভিযোগে। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ এতই অকাট্য ছিল যে তাকে অ্যাসিজেসে[‡] পেশ করা হয়। আমার কাছে এই ঘটনার কাগজপত্র আছে মনে হয়।” হোমস কাগজপত্র হাতড়ে, তারিখের উপর চোখ বুলিয়ে, একটাকে বের করে আনল। তারপর সেটা দু-ভাঁজ করে পড়তে শুরু করল:
হোটেল কসমোপলিটান থেকে চুরি রত্ন। এমাসের ২২ তারিখে কাউন্টেস অফ মোরকারের গয়নার বাক্স থেকে নীল পদ্মরাগ নামে একটি মহামূল্য রত্ন চুরির অভিযোগে জন হরনার নামে এক ছাব্বিশ বছর বয়সী কলের মিস্ত্রিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হোটেলের প্রধান-পরিচারক জেমস রাইডারের সাক্ষ্য থেকে জানা গিয়েছে যে, রাইডার হরনারকে কাউন্টসের ড্রেসিং রুমে নিয়ে এসেছিল একটা ফায়ার প্লেসের একটা ভাঙা শিক ঝালাই করানোর জন্য। রাইডার কিছুক্ষণ হরনারের সঙ্গে ছিল। তারপর রাইডারের ডাক পড়ায় সে কিছুক্ষণ হরনারকে একলা রেখে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যায়। ফিরে এসে সে দেখে হরনার চলে গেছে। ঘরের দেরাজ ভাঙা। যে ছোট্টো মরোক্কীয় বাক্সে কাউন্টসে রত্নটি রাখতেন, সেটি খালি অবস্থায় ড্রেসিং টেবিলের উপর খোলা পড়ে আছে। রাইডার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বাজায়। সেই দিন সন্ধ্যেবেলাই হরনারকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু রত্নটা তার কাছে বা তার ঘরে কোথাও পাওয়া যায়নি। কাউন্টেসের খাস-পরিচারিকা ক্যাথারিন কাসক রাইডারের চিৎকার শুনে ছুটে আসে। তার সাক্ষ্যের সঙ্গে রাইডারের সাক্ষ্য হুবহু মিলে গেছে। বি ডিভিশনের ইনস্পেক্টর ব্র্যাডস্ট্রিট হরনারকে গ্রেফতার করার কথা জানান। তিনি বলেন, হরনার গ্রেফতারের সময় পাগলের মতো ছটফট করছিল এবং খুব কড়া ভাষায় নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করছিল। তার বিরুদ্ধে আগেও ডাকাতির অভিযোগ থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট চটজলদি কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে তাকে অ্যাসিজেসে পাঠিয়ে দেন। অভিযুক্ত অত্যন্ত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের রায় শুনে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন তাকে ধরাধরি করে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়।
কাগজটা পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হোমস খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “হুম! এই হল পুলিশ-কোর্টের ব্যাপার। এখন আমাদের কাছে প্রশ্ন হল, গয়নার বাক্স থেকে খোয়া যাওয়ার পর টটেনহ্যাম কোর্ট রোডের হাঁসের পেটে রত্নটা গেল কী করে? দেখলে তো, ওয়াটসন, আমাদের ওই একটুখানি পর্যবেক্ষণজনিত অনুমান কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে! ব্যাপারটাকে আর নেহাতই নিরীহ ব্যাপার বলা চলে না। এই পাথরটা বেরোলো হাঁসের পেট থেকে। হাঁসটা মিস্টার হেনরি বেকারের–যে ভদ্রলোকের খারাপ টুপি আর অন্যান্য চরিত্রবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে তোমাকে এতক্ষণ বিরক্ত করছিলাম। এবার আমাদের সবার আগে কাজ হবে ভদ্রলোককে খুঁজে বের করা এবং এই ছোট্টো রহস্যটায় তাঁর কী ভূমিকা রয়েছে সেটা জানা। তা করতে হতে আমাদের প্রথমে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিটি অবলম্বন করতে হবে। সন্ধ্যের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিতে হবে। কাজ না হলে, তখন অন্য পদ্ধতি ভাবব।”