“ভদ্রলোক হারানো-প্রাপ্তির বিজ্ঞাপন দেননি?”
“না।”
“তুমি তাহলে কী সূত্র পেলে?”
“পর্যবেক্ষণ করে যতটুকু অনুমান করা যায়, ততটুকুই।”
“এই টুপিটা পর্যবেক্ষণ করে?”
“হ্যাঁ।”
“ঠাট্টা করছ? এই পুরনো ফুটো টুপিটা পর্যবেক্ষণ করে তুমি কী অনুমান করলে শুনি!”
“আমার পদ্ধতি তোমার জানা। এই লেন্সটা নাও। দ্যাখো তো, জিনিসটা পর্যবেক্ষণ করে তুমি এর মালিক সম্পর্কে কী ধারণা পাও।”
জিনিসটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলাম। খুব সাধারণ কালো রঙের একটা গোল টুপি। শক্তপোক্ত, তবে অবস্থা খুব খারাপ। ভিতরে রংচটা লাল রেশমের লাইনিং। নির্মাতার নাম নেই। তবে, হোমস যেমন বলেছিল–‘এইচ. বি.’ আদ্যক্ষরটা এককোণে খুব এবড়োখেবড়ো হরফে লেখা। দু-পাশে টুপি আটকানোর ছিদ্র। তবে ইলাস্টিকটা ছেঁড়া। ছেঁড়াফোঁড়া, ধুলোমাখা টুপি। জায়গায় জায়গায় দাগ। আবার কালি লাগিয়ে দাগগুলো ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে।
টুপিটা আমার বন্ধুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললুম, “কিছুই তো দেখতে পেলুম না।”
“ভুল করছ, ওয়াটসন, সবই দেখতে পেয়েছো। শুধু জানতে পারোনি যে দেখতে পেয়েছো। আসলে কার্যকারণগুলো ঠিকঠাক মেলাতে পারছো না।”
“তাহলে দয়া করে তুমিই বলো এই টুপি থেকে কী কার্যকারণ আবিষ্কার করলে?”
টুপিটা হাতে তুলে নিয়ে নিজের স্বভাবসিদ্ধ অদ্ভুত পর্যবেক্ষণ ভঙ্গিতে সেটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল হোমস। তারপর বলল, “সবটা হয়তো সঠিক জানা যাবে না। তবে কয়েকটা জিনিস খুব স্পষ্ট; অন্যগুলোর সম্ভাবনাও বেশ উজ্জ্বল। যেমন, এই লোকটা যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে। গত তিন বছরের মধ্যে কোনো এক সময় তার অবস্থা বেশ ভাল ছিল। তারপর কোনো কারণে অর্থসংকটে পড়ে। আগে লোকটার বেশ দূরদৃষ্টি ছিল। এখন সেই দূরদৃষ্টি আর নেই। পকেটের জোর কমে যাওয়ায় স্বভাবটাও একটু খারাপ হয়েছে। মদ্যপানের মতো খারাপ উপসর্গও সম্ভবত জুটেছে। তাছাড়া, খুব জোর দিয়ে বলা চলে, ভদ্রলোকের স্ত্রী আর তাঁকে আগের মতন ভালবাসেন না।”
“বটে!”
আমার ব্যঙ্গোক্তি ধর্তব্যের মধ্যে না এনে হোমস বলে চলল, “তবে কিছুটা আত্মমর্যাদাবোধ এখনও লোকটার মধ্যে রয়ে গেছে। লোকটা অলস প্রকৃতির। বেশি বাইরে বেরোয়-টেরোয় না। শরীরও বিশেষ দেয় না। মাঝবয়সী। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। কিছুদিন আগেই কেটেছে। মাথায় লাইম-ক্রিম মাখে। এই টুপি থেকে এই ব্যাপারগুলোই নিশ্চিত করে বলে যায়। আর হ্যাঁ, খুব সম্ভবত লোকটার বাড়িতে গ্যাসের আলো নেই।”
“ঠাট্টা করছ, হোমস?”
“এক বর্ণও না। এত কথার পরেও বলে দিতে হবে যে, কি করে এগুলো জানতে পারলাম?”
“আচ্ছা, আমি না হয় বোকাসোকা লোক। তোমার কথার কিছুই বুঝি না। কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে যে, এই লোকটা বুদ্ধিমান?”
উত্তরে হোমস টুপিটা নিজের মাথায় পরল। তার কপাল ঢেকে দিয়ে তার নাকের ডগা অবধি নেমে এল সেটা। সেটা দেখিয়ে হোমস বলল, “টুপিটার আকারটাই বলে দেয়, এত বড়ো মাথা যার, তার মগজেই নিশ্চয় কিছু আছে।”
“কী করে বুঝলে লোকটার অবস্থা আগে স্বচ্ছল ছিল; কিন্তু এখন অবস্থা পড়ে গেছে?”
“এই টুপিটা বছর তিনেকের পুরনো। এই রকম বাঁকা ধারওয়ালা টুপি তখনই বাজারে উঠেছিল। এমনিতে এটা খুব ভাল মানের টুপি। রেশমের বেড় আর লাইনিং-এর কাপড়টা দ্যাখো। বেশ দামি। যদি লোকটা তিন বছর আগে এই টুপিটা কিনতে পারে, এবং তারপর আর টুপিটা না পালটায় তাহলে বুঝতে হবে তাঁর অবস্থা এখন ভাল যাচ্ছে না।”
“আচ্ছা বেশ, বোঝা গেল। কিন্তু তাঁর দূরদর্শিতা ও আত্মসম্মানবোধের কী প্রমাণ পেলে?”
শার্লক হোমস হাসল। ছোট্টো চাকতি আর আঙটার উপর হাত রেখে বলল, “এখানেই আছে দূরদৃষ্টির পরিচয়। এগুলো টুপিতে লাগানো থাকে না। লোকটা নিশ্চয় অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে, লোকটার দূরদৃষ্টি আছে। টুপিটা যাতে হাওয়ায় না উড়ে যায় এটা তারই ব্যবস্থা। কিন্তু দ্যাখো, এর ইলাস্টিকটা ছিঁড়ে গেছে। লোকটাও সেটা নতুন করে লাগায়নি। তার মানে দূরদৃষ্টি তার আগের থেকে কমে এসেছে। এটা স্বভাবের দুর্বলতার লক্ষণ। অন্যদিকে এই দাগগুলো কালি দিয়ে ঢাকার চেষ্টাটাই বলে দিচ্ছে লোকটা এখনও তার আত্মমর্যাদাবোধ সম্পূর্ণ হারায়নি।”
“হুম! তুমি যা বলছ, তা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না!”
“আরও শুনবে? এই লোকটা মাঝবয়সী, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, সম্প্রতি চুল কেটেছে, লাইম-ক্রিম ব্যবহার করে–এসবের প্রমাণ কী? লাইনিং-এর নিচের অংশটুকু খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করে দ্যাখো। লেন্স দিয়ে দেখলে দেখবে, নাপিতের কাঁচিতে কাটা চুলের কয়েকটা ডগা চিটে আছে। আর লাইম-ক্রিমের একটা আবছা গন্ধ পাবে। এই যে ধুলো দেখছো, এটা রাস্তার খড়খড়ে ধূসর ধুলো নয়, এই রকম হালকা বাদামি ধুলো বাড়ির ভিতরেই দেখা যায়। তার মানে এটা বেশির ভাগ সময় ঘরের মধ্যেই টাঙানো থাকে। টুপির ভিতরে ঘামের দাগ দেখে বুঝবে লোকটা খুব ঘামে। কারোর মাথা এতো ঘামা সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।”
“কিন্তু কিভাবে বুঝলে যে, তাঁর স্ত্রী তাঁকে আর আগের মতন ভালবাসেন না?”
“এই টুপিতে বেশ কয়েক সপ্তাহ ব্রাশ পড়েনি। ওয়াটসন, তোমার বউ যদি তোমাকে এই রকম ধুলোমাখা টুপি পরে বাইরে যেতে দেয়, তাহলে জানবে তুমি একটি হতভাগা। তোমার বউ আর তোমাকে ভালবাসে না।”