‘সে কি? তুমি তো এই রকম একটা সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলে।’
‘দেখ ভাই, এতে আমার কি লাভ হবে? ধরা যাক, আমি রহস্যটা উদঘাটন করলাম। ঠিক জানবে তখন ঐ গ্লেগসন, লেস্ট্রেড কোম্পানিই সব বাহাদুরিটা পকেটস্থ করবে। বেসরকারী লোকদের এই তো বরাত।’
‘কিন্তু তিনি তো তোমার সাহায্য চেয়েছেন।’
‘তা চেয়েছে। সে জানে বুদ্ধিতে আমি তার থেকে বড় আর আমার কাছে সেকথা সে স্বীকারও করে। কিন্তু কোন তৃতীয় ব্যক্তির কাছে সে কথা স্বীকার করার আগে সে বরং তার জিভটাই কেটে ফেলে দেবে। যাহোক, তবু যাওয়াই যাক। দেখে আসি ব্যাপারটা। আমার বড়শিতে আমি মাছ ধরব। আম কিছু না পাই, তাদের দেখে একটু হাসতে পারব। চল।’
ওভারকোটটা গায়ে চড়িয়ে এমন তাড়াহুড়ো করতে শুরু করল যে মনে হল, উদাসীনতার ভাব কাটিয়ে উদ্যম-শীলতা তার উপর ভর করেছে।
‘তোমার টুপিটা নিও,’ সে বলল।
‘তুমি বলছ আমাকে যেতে?’
‘হ্যাঁ। অবশ্য যদি এর চেয়ে বড় কাজ কিছু না থাকে।’
এক মিনিট পরেই একটা ভাড়াটে গাড়ি নিয়ে আমরা দ্রুত ছুটে চললাম ব্রিকসটন রোডের দিকে।
কুয়াসাঢাকা মেঘাচ্ছন্ন সকাল। বাড়িগুলোর মাথার একটা বাদামী আবরণ ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে, যেন নীচে মেটে রঙের রাস্তায় ছায়া পড়েছে। আমার সঙ্গী খুব খোশ মেজাজে চলেছে। আমি চলেছি নীরবে। একে এই বিষণ আবহাওয়া, তার উপর চলেছি একটি বেদনাদায়ক কাজে। আমার মন একেবারেই নেতিয়ে পড়েছে।
হোমস তখন একমনে সঙ্গীতপ্রসঙ্গে কথা বলে চলেছে। তাকে বাধা দিয়েই বললাম, ‘হাতের কাজে খুব মন দিচ্ছ বলে তো মনে হয় না।’
সে জবাব দিল, ‘এখনও কোন তথ্যই পাই নি। সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগৃতীত হবার আগেই মত গঠন করা মস্ত ভূল। তাতে বিচারশক্তি প্রভাবিত হয়।’
আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে আমি বললাম, ‘শীঘ্রই তথ্য পেয়ে যাবে। এইটেই ব্রিকসটন রোড, আর আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে ঐটেই সেই বাড়ি।’
‘ঠিক। কোচম্যান, গাড়ি থামাও।’ তখনও আমরা শ’খানেক গজ দুরে। কিন্তু তার নির্দেশে সেখানেই নামতে হল। বাকিটা হেঁটে গেলাম।
৩ নম্বর লরিস্টন গার্ডেন্স একটা অশুভ ভয়ংকর চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে চারটে বাড়ি রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত এটা তাদেরই একটা। চারটে বাড়ির দুটোয় লোক আছে, দুটো খালি। শেষের দুটো বাড়িতে দেখা যাচ্ছে তিন সারি খোলা জানালা, আর এখানে-ওখানো ছিটানো-ছড়ানো কিছু কিছু ছোট গাছের একটা বাগান বাড়িগুলোকে রাস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। কাদা ও পাথরের একটা হলদেটে সংকীর্ণ পথ বাগানের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। রাতের বৃষ্টিতে সমস্ত জায়গাটাই সত্যিসেতে। বাগানের চারধারে তিন-ফুট উঁচু ইটের পাঁচিল। তার উপরে একটুকরো কাঠের রেল বসানো দেওয়ালে হেলান দিয়ে একজন হৃষ্টপুষ্ট পুলিশ কনেস্টবল দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভীড় করে আছে পথচারীদের একটা ছোট দঙ্গল। বকের মত গলা বাড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তারা ভিতরে কি ঘটেছে সেটা দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
আমি ভেবেছিলাম, শার্লক হোমস সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভিতরে ঢুকে রহস্য সমাধানের লেগে যাবে। সে কিন্তু সেদিক দিয়েই গেল না। সম্পূর্ণ অনামনস্কভাবে সে ফুটপাতে পায়চারি করতে লাগল। কখনও মাটির দিকে, কখনও আকাশের দিকে, উল্টো দিকের বাড়িগুলোর দিকে, আবার কখনও বা রেলিংএর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সবকিছু দেখে ধীরে ধীরে পথটা ধরে—বরং বলা উঁচিত পথের দু’ধারের ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। চোখ দুটো সারাক্ষণই মাটির দিকে নিবন্ধ। দু’বার থামল। একবার তার মুখে হাসি দেখলাম। একটা খুশির উল্লাসও
যেন কানে এল। ভিজে আঠালো মাটিতে অনেক পায়ের ছাপ পড়েছে। কিন্তু এপথে তো অনেক পুলিশ যাতায়ত করছে, সুতরাং থেকে আমার সঙ্গী যে কি জিনিসের আশা করছে আমি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তার দ্রুত দর্শন ক্ষমতার এমন সব অসাধারণ প্রমাণ আমি পেয়েছি যাতে আমি নিঃসন্দেহ যে সে এমন অনেক কিছু দেখতে পায় যা আমাদের কাছে থাকে লুকনো।
বাড়ির দরজায়ই একটি লম্বা, সাদা-মুখ, শনের মত চুলওয়ালা লোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হল। তার হাতে একটা নোট বুক। ছুটে এসে সে মহা উৎসাহে আমার সঙ্গীর করমর্দন করে বলল. ‘আপনি এসে পড়ায় অনুগৃহত হলাম। দেখুন, কোন কিছুই আমি স্পর্শ করতে দেই নি।’
‘ঐটে ছাড়া!’ পথটা দেখিয়ে আমার বন্ধু বলল। ‘একপাল মোষ ওখান দিয়ে হেঁটে গেলেও এর চাইতে জগাখিচুড়ি হোত না। গ্রেগসন, এটা হতে দেবার আগেই তোমার নিজস্ব সিন্ধান্তে নিশ্চয়ই উপনীত হয়েছিলে?
গোয়েন্দাপ্রবর তার কথাটা এড়িয়ে বলল, ‘বাড়ির ভিতরে আমার অনেক কাজ ছিল। আমার সহকর্মী ভিতরে আমার অনেক কাজ ছিল। এটা দেখবার ভার তার উপরেই ছিল।’
হোমস আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের ভঙ্গীতে ভুরু দুটো তুলে বলল, ‘তুমি এবং লেস্ট্রেড যখন আসরে নেমেছ তখন আর তৃতীয় ব্যক্তির করবার কিছু থাকতে পারে না।
আত্মসন্তুষ্টিতে দুই হাত ঘসতে ঘসতে গ্রেগসন বলল, ‘যাকিছু করণীয় সবই তো করেছি বলে মনে হয়। যদিও কেসটা অদ্ভুত আর এ ধরনের কেস আপনি যে ভাল বাসেন তাও জানি।’
শার্লক হোমস প্রশ্ন করল, ‘তুমি তো ভাড়াটে গাড়িতে এখানে আসনি?’
না।’
‘লেস্ট্রেডও নয়?’
‘না স্যার।’
‘তাহলে চল ঘরটা একবার দেখি। ‘ এই অবান্তর মন্তব্য করে সে বাড়ির ভিতর ঢুকল। পিছনে গ্রেগসন। তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ।