ঘরের ভিতরে ঢুকে বন্ধুর হাতে চিঠিখানা দিয়ে সে বলল, ‘মিঃ শার্লক হোমসের জন্য।‘
এতক্ষণে তার মুখোশ খুলে দেবার একটা সুযোগ পাওয়া গেল। আচমকা একটা কথা বলে ফেলবার সময় এরকমটা যে ঘটতে পারে তা তো আর সে ভাবতে পারে নি। সরাসরি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কোথায় কাজ করেন জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?’
রূঢ়কণ্ঠে সে জবাব দিল, ‘সেনাবিভাগে, ইউনিফর্মটা মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে।‘
ঈর্ষার দৃষ্টিতে সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি ছিলেন?’
‘সার্জেণ্ট স্যার। রাজকীয় নৌবাহিনীর পদাতিক বাহিনী স্যার। কোন জবাব দেবেন না? ঠিক আছে স্যার।‘
দুটো গোড়ালি ঠুকে হাত তুলে সে স্যালুট করল। তারপরই চলে গেল।
০৩. লরিস্টন গার্ডেন্স-এর রহস্য
স্বীকার করছি, আমার সঙ্গীর মতবাদের বাস্তবতার এই নতুন প্রমাণ আমাকে বিস্মিত করেছিল। তার বিশেল-ষণী শক্তির প্রতি আমার শ্রদ্ধা বহুগুণে বেড়ে গেল। একটা । সন্দেহ কিন্তু তখনও উঁকি দিতে লাগল যে, আমাকে চমকে দেবার জন্য সমস্ত ব্যাপারটাই আগে থেকে সাজানো, অবশ্য আমাকে চমকে দিয়ে তার কি লাভ হবে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। তাঁকিয়ে দেখি, সে চিঠিটা পড়ে ফেলেছে। তার চোখে এমন একটা শূন্য অনুজ্জ্বল দৃষ্টি যে দেখলেই মনে হয় সে তার মনের মধ্যে ডুবে গেছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, ওটা তুমি জানলে কেমন করে?’
সে যেন একটু চটেই বলল, ‘কোনটা?’
‘কেন? ওই লোকটা যে নৌবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট, সেটা?’
‘এসব তুচ্ছ কথা বলবার মত সময় নেই, ‘কোনটা?’
‘রূঢ় কণ্ঠেই জবাব সে জবাব দিল। তারপরই হেসে বলল, ‘এই রূঢ়তার জন্য আমাকে ক্ষমা কর। আমার চিন্তার সুতোটা তুমি ছিঁড়ে ফেলছিলে। কিন্তু তুমি কি সত্য সত্যই বুঝতে পারো নি যে লোকটি নৌবিভাগের সার্জেন্ট ছিল?’
‘মোটেই না।’
‘আমি কি করে জানলাম সেটা বোঝানোর চাইতে ওটা অনেক সহজ। তোমাকে যদি বলা হয় দুই আর দুইয়ে যে চার হয় সেটা প্রমাণ কর, তাহলে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই একটু কঠিন মনে হবে, অথচ তুমি নিশ্চিত জান যে এটা সত্য। রাস্তার ওপাশে থাকতেই লোকটির হাতের উল্টো পিঠে একটা বড় নীল নোঙরের উল্কি আমার চোখে পড়ে-ছিল। তাতেই সমুদ্রের গন্ধ পেলাম। তার আচরণের এবং দুদিকে পাকানো গোঁফ ছিল সামরিক গন্ধ। কাজেই পাওয়া গেল নৌবিভাগ। লোকটির মধ্যে কিছুটা ভারিক্কি-য়ানা এবং প্রভুত্বের ভঙ্গীও আমার চোখ এড়ায় নি। যেভাবে সে মাথাটা উঁচু করে ছিল এবং হাতের বেতটা ঘোরাচ্ছিল সেটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ।তার মুখে চোখে একটা স্থির, সম্ভ্রান্ত, মধ্যবয়স্ক মানুষের ছাপ—এই সব দেখেই মনে হল সে সার্জেন্ট ছিল।’
‘চমৎতার।’ আমি সোল্লাসে বলে উঠলাম।
হোমস বলল, ‘অতি সাধারণ।’ যদিও তার কথা শুনে আমার মনে হল, আমার বিস্ময় ও প্রশংসা শুনে সে খুশিই হয়েছে। ‘এইমাত্র বলছিলাম যে আজকাল আর অপরাধী নেই। মনে হচ্ছে-আমি ভুল বলেছি। এটা দেখ! প্রাক্তন সার্জেন্টের দেওয়া চিঠিখানা সে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল।
‘সে কি।’ চোখ বুলিয়েই আমি চীৎকার করে উঠলাম, ‘এ যে সাংঘাতিক।’
সে শান্তভাবে বলল, ‘একটা অসাধারণ কিছু বলে মনে হচ্ছে। তুমি কি চিঠিটা আমাকে পড়ে শোনাবে?’
নীচের চিঠিটা আমি তাকে পড়ে শোনালামঃ
প্রিয় মিঃ শার্লক হোমস,
৩, লরিস্টন গার্ডেন্সে গত রাতে একটি খারাপ ঘটনা ঘটেছে। লরিস্টন গার্ডেন্স বেরিয়েছে ব্রিক্সটন রোড থেকে। প্রায় দুটো নাগাদ আমাদের বীটের পুলিশ সেখানে একটা আলো দেখতে পায়। যেহেতু বাড়িটা তখন খালি ছিল, তার মনে সন্দেহ দেখা দেয়। গিয়ে দেখে দরজা খোলা আর আসবাব-পত্রহীন সামনের ঘরে জৈনক ভদ্র-লোকের মৃতদেহ পড়ে আছে।লোকটি সুসজ্জিত। তার পকেটে একটা কার্ড পাওয়া গেছে। তাতে লেখা ‘এনক জে, ড্রেবার, ক্লিভল্যান্ড, ওহিও, ইউ, এস, এ,।’ কোন—রকম ডাকাতি হয় নি এবং ভদ্রলোক কেমন করে মারা গেলেন তারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ঘরের মধ্যে রক্তের দাগ আছে, কিন্তু লোকটির দেহে আঘাতের কোন চিহ্নই নেই। তিনি কি করে ঐ খালি বাড়িতে এলেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। বস্তুতঃ সমস্ত ব্যাপারটাই যেন ধাঁধার মত। বারোটার আগে যে-কোন সময় আপনি যদি ঐ বাড়িতে আসতে পারেন, আমাকে ওখানেই পাবেন। আপনার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সব কিছুই যেমনটি ছিল তেমনটি রেখে দিয়েছে। যদি আসতে না পারেন, আরও বিস্তারিত বিধরণ জানাব। দয়া করে যদি আপনার মতামত পাঠান তাহলে সেটাকে আপনার সসীম অনূগ্রহ বলে বিবেচনা করব।
ভবদীয়
টোবিয়াস প্রেগসন
বন্ধু মন্তব্য করল, ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসারদের মধ্যে সবচাইতে চালাক-চতুর। সে এবং লেস্ট্রেডই হচ্ছে মন্দের ভাল। দু’জনই দ্রুতবুদ্ধি এবং উদ্যমশীল, কিন্তু গতানুগতিক-ভয়ানক গতানুগতিক। তাদের মধ্যে ব্রেধরেষিও আছে। দুই পেশাদার সুন্দরীর মতই তারা পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাকার। এই কেসে তাদের দুজনের হাতেই যদি কিছুটা সুতো ধরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ভারি মজা হবে।’
তার শান্তভাবে কথা বলার রকম দেখে আমি বিস্মিত হলাম। চীৎকার করে বললাম, ‘আর এক মহুর্তেও নষ্ট করা উচিত নয়। তোমার জন্য একটা গাড়ি ডেকে দেব কি?’
‘আমি যাব কি না তাই তো বুঝতে পারছি না।আলসেমি যখন আমার উপর ভর করে তখন আমি একে-বারে আলসের গুরুঠাকুর। অবশ্য অন্য সময় আমি খুব চটপটেও হতে পারি।’