‘আর অন্যরা?’
‘বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পাঠায় বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থা। কোন ব্যাপার নিয়ে গোলমালে পড়লেই তারা আলোকপাতের জন্য আসে। আমি তাদের কাহিনী মন দিয়ে শুনি, তারা আমার মন্তব্যগুলি মন দিয়ে শোনে, তারপর আমার ফীটা পকেটস্থ করি।‘
আমি বললাম, ‘তুমি কি বলতে চাও, সচক্ষে সব বিবরণ দেখেও যে রহস্যের কিনারা তারা করতে পারে না, তুমি এই ঘরে বসেই তার গিট খুলতে পার?’
‘ঠিক তাই। এবিষয়ে আমার কেমন একটা অন্তর্দৃষ্টি আছে। কখনও সখনও এমন কেস আসে যেটা একটু বেশী জটিল। তখন অবশ্য আমাকেও বাইরে বেরিয়ে নিজের চোখে সবকিছু দেখতে হয়। দেখ, আমার কতকগুলি বিশেষ জ্ঞান আছে যেগুলি প্রয়োগ করে আমি আশ্চর্য ফল পাই। এই প্রবন্ধে অনুমানের যেসব নিয়ম উল্লেখ করা হয়েছে এবং যেগুলি তোমার ঘৃণার উদ্রেক করেছে সেগুলি কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমার কাছে খুবই মূল্যবান। পর্যবেক্ষণ আমার দ্বিতীয় প্রকৃতি। প্রথম দিন সাক্ষাতের সময় আমি যখন বললাম যে তুমি আফগানিস্থান থেকে এসেছ, তখন তুমি বিস্মিত হয়েছিলে।‘
‘নিশ্চয় কেউ তোমাকে বলেছিল।‘
‘মোটেই তা নয়। আমি স্রেফ জানতে পেরেছিলাম যে তুমি আফগানিস্থান থেকে এসেছ। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে চিন্তা-স্রোত এত দ্রুতগতিতে আমার মনে প্রবাহিত হয়ে যে অন্তবর্তী ধাপগুলো চিন্তা না করেই আমি সরাসরি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। অবশ্য সে ধাপগুলো তো থাকেই। চিন্তার ধারাটা এই রকম ছিল; এই ভদ্রলোক ডাক্তার, অথচ চালচলনে সামরিক ভাবভঙ্গি, কাজেই নিশ্চয় সামরিক ডাক্তার। তিনি নিশ্চয় সম্প্রতি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে এসেছেন, কারণ তার মুখমণ্ডল বাদামী, অথচ ওটা তাঁর চামড়ার স্বাভাবিক রং নয় যেহেতু তার কব্জী দুটো সাদা। তাঁর বিষন্ন মুখ দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি অনেক দুঃখ-কষ্ট ও রোগ ভোগ করেছেন। তাঁর বাঁ হাতটায় আঘাত লেগেছে কারণ সে হাতটা তিনি অস্বাভাবিকভাবে আড়ষ্ট করে রাখেন। গ্রীষ্মমণ্ডলের কোন্ স্থানে একজন ইংরেজ সামরিক ডাক্তারের পক্ষে এরকম কষ্ট ভোগ করা সম্ভব? আর কোথায়ই বা তাঁর হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে? নিশ্চয় আফগানিস্থানে। এই পুরো চিন্তাধারাটি কিন্তু এক সেকেণ্ডও সময় নেয় নি। আমি তখনই মন্তব্য করলাম, তুমি আফগানিস্থান থেকে এসেছ, আর তুমিও বিস্মিত হলে।‘
হেসে বললাম, ‘তুমি বুঝিয়ে বলার পরে অবশ্য ব্যাপারটা সরলই মনে হচ্ছে। এডগার এলেন পো-র ডিউপিনের কথা মনে পড়ছে। গল্পের বাইরেও এ ধরনের চরিত্র থাকে আমার জানা ছিল না।‘
শার্লক হোমস উঠে পাইপটা ধরাল। তারপর বলতে লাগল, ‘তুমি নিঃসন্দেহে ভাবছ যে ডিউপিনের সঙ্গে তুলনা করে আমার প্রশংসাই করছ। কিন্তু আমার মতে ডিউপিন খুব সাধারণ স্তরের মানুষ। পনের মিনিট চুপ করে থেকে হঠাৎ একটা যুৎসই মন্তব্য করে বন্ধুকে চমকে দেওয়ার যে কৌশল তিনি দেখান সেটা আসলে কিন্তু বড়ই লোক-দেখানো ও কৃত্রিম। অবশ্য বিশ্লেষণী শক্তি তাঁর ছিল, কিন্তু পো তাঁকে যতখানি বড় বলে কল্পনা করেছেন আসলে তিনি তা নন।‘
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি গাবোরিয়-র বই পড়েছ? তোমার মতে লিকক কি একজন ভাল গোয়েন্দা?’
শার্লক হোমস ঠাট্টার ভঙ্গীতে নাকটা টানল। তারপর রাগতঃ স্বরে বলল, ‘লিকক তো একটা মহা আনাড়ি। একটা গুণই তার ছিল,–উৎসাহ। ও বই পড়ে তো আমি কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। ব্যাপার কি না, একটি অজানা কয়েদিকে খুঁজে বের করতে হবে। আমি ও কাজ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই করতে পারতাম। লিককের লেগেছিল ছ’মাস বা ওই রকম সময়। গোয়েন্দাদের কি বাদ দেওয়া উচিত সেটা শেখবার মত পাঠ্য-পুস্তক অবশ্য ও বইখানা হতে পারে।‘
যে দুটি চরিত্র আমার প্রিয় তাদের সম্পর্কে এই ধরনের উদ্ধত উক্তি করায় আমি কিছুটা অসন্তুষ্ট হলাম।
জানালার কাছে উঠে গিয়ে বাইরের জনবহুল রাস্তার দিকে তাকালাম। মনে মনে বললাম, ‘লোকটি চতুর বটে, তবে বড় দাম্ভিক।‘
যে দুঃখের সঙ্গেই সে বলল, ‘আজকাল আর অপরাধও নেই, অপরাধীও নেই। আমাদের কাজে এখন আর মস্তিষ্কের প্রয়োজন হয় না। আমি জানি, আমার মধ্যে ও বস্তুটি আমাকে বিখ্যা করবার পক্ষে পর্যাপ্তই আছে। অপরাধ উদঘাটনের কাজে যতটা পড়াশুনা এবং মেধা আমি প্রয়োগ করেছি আজ পর্যন্ত অপর কেউ তা করে নি। কিন্তু লাভ কি হল? ধরবার মত কোন অপরাধই ঘটে না। আর যাও বা ঘটে এতই জলের মত পরিষ্কার যে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের যে কোন অফিসারই তার কিনারা করতে পারে।
লোকটির কথাবার্তার এই আত্মম্ভরিতা ক্রমেই আমাকে বিরক্ত করে তুলল কাজেই ভাবলাম এ প্রসঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
একটি দীর্ঘদেহ সাদাসিধে পোশাকের মানুষ রাস্তার অপর দিকে ধরে বাড়ির নম্বর দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল। তার হাতে একখানা নীল রঙের বড় খাম। নিশ্চয় কোন সংবাদ নিয়ে এসেছে। তাকে দেখিয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘লোকটি না জানি কি খুঁজে বেড়াচ্ছে।‘
শার্লক হোমস বলল, ‘নৌবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সার্জণ্টের কথা বলছ?’
‘খালি বড়াই আর দম্ভ!’ মনে মনে ভাবলাম। ‘ভাল করেই জানে যে ওর এই অনুমানকে আমি পরখ করে দেখতে পারব না।‘
এ কথাগুলি ভাবতে না ভাবতেই লোকটি আমাদের দরজাতেই তার প্রার্থিত নম্বরটি দেখতে পেয়ে দ্রুতপায়ে রাস্তাটা পার হল। আমাদের কানে এল দরজায় ধাক্কার শব্দ, নীচে একটি গম্ভীর কণ্ঠস্বর এবং সিঁড়ি বেয়ে উঠবে ভারী পদধ্বনি।