আমার বেশ মনে আছে, সেদিনটা ছিল ৪ঠা মার্চ। অন্য দিনের তুলনায় একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছিলাম। দেখলাম, শার্লক হোমসের প্রাতরাশ তখনও সারা হয় নি। গৃহকর্ত্রী আমার দেরীতে ওঠার ব্যাপারে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তখনও আমার প্রাতরাশ টেবিলে দেওয়া হয় নি, বা আমার কফিও তৈরী হয় নি। মানুষ অনেক সময় অকারণে রেগে যায়। আমিও সেইরকম রাগের সঙ্গে ঘণ্টাটা বাজিয়ে জানিয়ে দিলাম যে আমি তৈরী। তারপর টেবিল থেকে একখানা পত্রিকা টেনে নিয়ে তার উপর চোখ বুলিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। আমার সঙ্গী নীরবে টোস্টে কামড় দিচ্ছিল। একটা প্রবন্ধের শিরোনামের নীচে পেন্সিলের দাগ দেখে স্বভাবতই সেটার উপর দ্রুত চোখ বুলোতে লাগলাম।
প্রবন্ধের শিরোনামটি খুব জবরদস্ত—‘জীবনের পুঁথি।’ তাতে দেখানো হয়েছে, একজন অনুসন্ধিৎসু লোক সঠিক ও সুশৃঙ্খল পর্যবেক্ষণের ফলে জীবনের কতকিছু জানতে পারে। ব্যাপারটা কিন্তু আমার কাছে চাতুর্য ও অবাস্তবতার একটা খিঁচুড়ি বলে মনে হল। বেশ ধারালো ও তীক্ষ্ণ যুক্তি, কিন্তু সিদ্ধান্তগুলি কষ্টকল্পিত ও অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। লেখক দাবী করেছেন, একটি আকস্মিক কথা, মাংসপেশীর একটি মোচড় বা চোখের একটু দৃষ্টি থেকেই মানুষের মনের অন্তস্থল পর্যন্ত দেখা যায়। যে মানুষ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে সুশিক্ষিত তাকে ঠকানো অসম্ভব। তার সিদ্ধান্তগুলি ইউক্লিডের প্রতিপাদ্যের মতই অভ্রান্ত। কোন নূতন লোকের কাছে তার সিদ্ধান্তগুলি বিস্ময়কর মনে হবেই এবং যতক্ষণ তার অনুসৃত পদ্ধতিগুলি সে না শিখবে ততক্ষণ তাকে একজন যাদুকর বলেই মনে করবে।
লেখক বলেছেন, একজন যুক্তিবিদ একফোঁটা জল থেকে আতলান্তিক মহাসাগর বা নায়েগ্রা জলপ্রপাতের সম্ভবনাকে অনুমান করতে পারে, যদিও সে ও দুটোর একটাকেও দেখে নি, বা কারও থেকে ওদের সম্পর্কে কিছু শোনেও নি। সব জীবনই একটি প্রকাণ্ড শৃঙ্খল যার একটি গাঁটকে দেখতে পেলেই সমগ্রটাকে জানা যায়। অন্য সব শিল্প-কলার মত ‘অনুমান ও বিশ্লেষণ বিজ্ঞান’কেও সুদীর্ঘ অধ্যবসায় দ্বারাই আয়ত্ব করা যায়, এবং যেহেতু জীবন যথেষ্ট দীর্ঘস্থায়ী নয় সেজন্য কোনও মানুষের পক্ষেই এবিষয়ে পরিপূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়। কোন সমস্যার নৈতিক ও মানসিক দিকগুলি অত্যন্ত বিঘ্নসঙ্কুল; কাজেই ছোটখাট সমস্যাগুলিকে আয়ত্তে আনবার চেষ্টাই প্রথমে করা উচিত।
কোন মানুষের সঙ্গে দেখা হলে একনজরেই জানবার চেষ্টা করতে হবে তার অতীত ইতিহাস, তার বাণিজ্য বা অন্য জীবিকার পরিচয়। এরকম চেষ্টা প্রথমে বোকামির পরিচায়ক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু ফলে মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ক্ষুরধার হয় এবং কোথায় চোখ ফেলতে হবে বা কি দেখতে হবে সে শিক্ষা লাভ করা যায়। একটা মানুষের হাতের নখ, তার কোটের আস্তিন, জুতো, ট্রাউজারের হাঁটুর কাছটা, তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের উপরকার কড়া, তার কথা, তার শার্টের কফ—এর প্রত্যেকটি থেকেই মানুষের জীবিকার পরিচয় পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হয়। কোন একটি ক্ষেত্রে এর সবগুলি প্রয়োগ করেও একজন যোগ্য অনুসন্ধানকারী সমস্যার উপর আলোকপাত করতে অসমর্থ হবেন এটা একেবারেই অকল্পনীয়।
‘কী অবর্ণনীয় বাগাড়ম্বর!’ চীৎকার করে বলতে বলতে আমি পত্রিকাটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে দিলাম। ‘জীবনে এরকম বাজে লেখা কখনও পড়ি নি।’
‘কোনটার কথা বলছ?’ শার্লক হোলস প্রশ্ন করল।
প্রাতরাশ খেতে খেতে ডিমের চামচে দিয়ে দেখিয়ে আমি বললাম, ‘কেন, এই প্রবন্ধটা। মনে হচ্ছে তুমি এটা পড়েছ, কারণ এটার নীচে দাগ দিয়েছ। অস্বীকার করছি না যে লেখাটায় মুন্সিয়ানা আছে; আমি অবশ্য বিরক্ত হয়েছি। এটা নিশ্চয়ই কোন আরামকেদারাশ্রয়ী আলস্যবিলাসীর উদ্ভট মতবাদ। নিজের নির্জন পড়ার ঘরে বসে তিনি এই সব অবাস্তব কথার জাল বোনে। এসব একেবারেই অবাস্তব। আমার ইচ্ছা করে, পাতাল-রেলের কোন তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় ঠেলে দিয়ে তাকে বলি, এবার সহযাত্রীদের জীবিকার পরিচয়গুলি দাও তো বাপধন। তার সঙ্গে আমি হাজার পাউণ্ড বাজী লড়তে রাজী।’
হোমস শান্তভাবে বলল, ‘তাতে তোমার টাকাটাই খোয়াবে। আর প্রবন্ধটার কথা যদি বল, ওটা আমি লিখেছি।’
‘তুমি!’
‘হ্যাঁ। পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের কাজে আমার একটা ঝোঁক আছে। সে-সকল মত আমি ওখানে প্রকাশ করেছি, এবং যেগুলিকে তুমি অত্যন্ত অবাস্তব বলে মনে করছ, সেগুলো অত্যন্ত বাস্তবসম্মত—এত বাস্তব যে আমার রুটি-মাখনের জন্য আমি ওগুলোর উপরই নির্ভর করি।‘
‘কিন্তু কেমন করে?’ নিজের অজ্ঞাতেই প্রশ্ন করলাম।
‘দেখ, আমারও একটা জীবিকা আছে। আমার ধারণা এ ব্যাপারে পৃথিবীতে আমি একক। আমি একজন পরামর্শদাতা গোয়েন্দা। অবশ্য সেটা কি জিনিস তুমি বুঝবে কি না জানি না। এই লণ্ডনে অনেক সরকারী ও বে-সরকারী গোয়েন্দা আছে। এরা যখন পেরে ওঠে না, তখন আমার কাছে আসে, আমি তাদের পথ বাতলে দি। তারা সংগৃহীত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি আমার কাছে পেশ করে, অপরাধ-ইতিহাসের যে জ্ঞান আমি অর্জন করেছি তারই সাহায্যে আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হই। বিভিন্ন দুষ্কর্মের মধ্যে একটা মূলগত মিল আছে; ফলে হাজারটা দুষ্কর্মের বিবরণ তুমি উদ্ধার করতে পারবে না এটা হতেই পারে না। লেস্ট্রেড একজন নামকরা গোয়েন্দা। সম্প্রতি একটা জালিয়াতির মামলা নিয়ে বড়ই গোলমালে পড়েছিল তাই আমার কাছে এসেছিল।’