উদ্বিগ্ন কণ্ঠে সে প্রশ্ন করল, ‘হট্টগোল বলতে কি আপনি বেহালা বাজানোটাকে ধরেছেন?’
‘সেটা বাদকের উপর নির্ভর করে,’ আমি জবাব দিলাম। ‘বেহালার ভাল বাজনা তো দেবতাদের উপভোগ্য। কিন্তু বাজনা যদি বাজে হয়—’
হো-হো করে হেসে সে বলল, ‘বাস, বাস, তাহলে ঠিক আছে। ধরে নিচ্ছি ব্যবস্থাটা পাকা, অবশ্য যদি বাসাটা আপনার পছন্দ হয়।’
‘কখন দেখা যায়?’
‘কাল দুপুরে এখানে আসুন। একসঙ্গে গিয়ে সব পাকা করে ফেলব,’ সে জবাব দিল।
করমর্দন করে আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। কাল দুপুরে।’
সে আবার কাজে মন দিল। আমরা হোটেলের দিকে পা বাড়ালামা।
হঠাৎ থেমে স্ট্যামফোর্ডের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলাম, ‘ভাল কথা, আমি আফগানিস্থান থেকে এসেছি উনি বুঝলেন কি করে?’
একটু রহস্যময় হাসি হেসে সঙ্গী বলল, ‘ঐটেই তাঁর বৈশিষ্ট্য। উনি যে কি করে সবকিছু বোঝেন, সেটা আরও অনেকে জানতে চেয়েছে।’
হাত ঘসতে ঘসতে আমি বললাম, ‘ওঃ! সেটা তাহলে একটা রহস্য? বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। আমাদের দুজনের মিলন ঘটিয়েছ বলে তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তুমি তো জান, “মানুষের উপযুক্ত পাঠ্য বিষয়ই হল মানুষ।’
বিদায় নেবার সময় স্ট্যামফোর্ড বলল, ‘তাহলে ওকে পাঠ কর। যদিও খুব জটিল সমস্যায় পড়বে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, তুমি তাকে যতটা জানতে পারবে তার চাইতে অনেক বেশী সে তোমাকে জানতে পারবে। নমস্কার।‘
‘নমস্কার।’ অপরিচিতের সম্পর্কে প্রচুর আগ্রহন নিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম।
০২. অনুমান বিজ্ঞান
তার ব্যবস্থামত পরদিন দেখা করলাম এবং ২২১বি, বেকার স্ট্রীটের ঘরগুলি দেখলাম। দুটো আরামদায়ক শয়ন-কক্ষ, একটি বড় খোলামেলা সুসজ্জিত বসবার ঘর, তাতে দুটো প্রশস্ত জানালা দিয়ে প্রচুর আলো এসে পড়ছে। সব দিক থেকেই বাসাটা ভাল এবং সম-অংশে ভাড়াটাও ন্যায্য বলেই মনে হয়। কাজেই সেখানেই কথাবার্তা পাকা করে সঙ্গে সঙ্গে বাসার দখল নিয়ে নিলাম। আমি সেদিন সন্ধ্যায়ই হোটেল থেকে মালপত্র নিয়ে সেখানে গেলাম। শার্লক হোমস পরদিন সকালে কয়েকটা বাক্স্ ও পোর্টম্যাণ্টো নিয়ে হাজির হল। মালপত্র খুলে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে দু’ একদিন কেটে গেল। ধীরে ধীরে দুজনেই নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম।
হোমসের সঙ্গে একত্রে বাস করা মোটেই কঠিন নয়। লোকটি চলা-ফেরায় শান্ত, স্বভাবে পরিমিত। রাত দশটার পরে কদাচিৎ জেগে থাকে, আর সকালে আমার ঘুম ভাঙবার আগেই প্রাতরাশ সেরে বাইরে বেরিয়ে যায়। কখনও সারাটা দিন কেমিক্যাল লেবরেটরিতে কাটায়। কখনও বা ব্যবচ্ছেদ-কক্ষে। আবার অনেকদিন শহরের অনুন্নত এলাকাগুলিতে দীর্ঘ পথ হেঁটে বেড়ায়। কাজের নেশা যখন পেয়ে বসে তখন কোন কাজেই সে পিছপা নয়। কখনও বা সম্পূর্ণ উল্টো। দিনের পর দিন বসবার ঘরে সোফায় বসে থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মুখে একটা কথা নেই, শরীরের একটু নড়ন-চড়ন নেই। সেসময় তার চোখে এমন একটা ফাঁকা স্বপ্নময় দৃষ্টি দেখেছি যাতে অনায়াসেই সন্দেহ হতে পারত যে নেশাখোর; কিন্তু তার সংযত ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রা দেখে সে ধারণা মনেও ঠাঁই পেত না।
যতদিন কাটতে লাগল, তার সম্পর্কে আমার আগ্রহ এবং তার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে আমার কৌতূহল ততই বাড়তে লাগল। তার শরীর এবং চেহারাই এমন যে যে-কোন লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। লম্বায় ছ’ ফুটের উপরে, কিন্তু এতটাই কৃশকায় যে আরও ঢ্যাড়া মনে হয়। যে নেশার ঘোরের কথা এইমাত্র উল্লেখ করেছি সেসময়টা ছাড়া সাধারণভাবে তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং অন্তর্ভেদী। বাজপাখির মত সরু নাক, সারা মুখে সদা-সতর্কতা ও স্থির সিদ্ধান্তের আভাষ ফুটিয়ে তোলে। তার মোটা চৌকো থুতনি দৃঢ় চরিত্র মানুষের লক্ষণ। তার দুই হাতে সব সময়ই কালি আর কেমিক্যালের দাগ লেগে থাকত। তা সত্ত্বেও কোন কিছু ছোঁবার বেলায় সে খুবই খুঁতখুঁতে। কাজের যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করবার সময় তার এই স্বভাব আমি অনেক সময় লক্ষ্য করেছি।
এই মানুষটি আমার কৌতূহলকে কতখানি জাগ্রত করেছিল, এবং নিজের সম্পর্কে তার নীরবতাকে ভাঙবার কতটা চেষ্টা আমি বারবার করেছি, সেকথা বললে পাঠক নিশ্চয়ই অনধিকার চর্চার অপরাধে আমার নিন্দা করবেন; কিন্তু তা করবার আগে মনে রাখতে হবে যে সেসময় আমার জীবন ছিল লক্ষ্যহীন এবং করবার মত কোন কাজও তখন আমার হাতে ছিল না। আমার স্বাস্থ্যের তখন যা অবস্থা তাতে আবহাওয়া অত্যন্ত ভাল না থাকলে আমি বাইরেও বেরোতে পারতাম না। এমন কোন বন্ধুও ছিল না যার সঙ্গে কথা বলে দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমিকে কাটাতে পারি। সে অবস্থায় এই সঙ্গীটিকে ঘিরে যে ছোটখাট রহস্য ছিল তার সমাধানের চেষ্টায়ই আমি অনে সময় কাটিয়ে দিতাম।
সে ডাক্তারি পড়ত না। এবিষয়ে স্ট্যামফোর্ড যা বলেছিল আমার একটা প্রশ্নের উত্তরে সে নিজেও সেই উক্তিই সমর্থন করেছে। সে নিয়মিতভাবে এমন কোন পড়াশুনা করে না যাতে সে বিজ্ঞানের একটা ডিগ্রি পাবার উপযুক্ততা অর্জন করতে পারে, অথবা জ্ঞান-রাজ্যে প্রবেশের অন্য যে কোন দ্বার-পথ তার সামনে উন্মুক্ত হতে পারে। কিন্তু কোন কোন পাঠ্য বিষয়ে তার উৎসাহ এতই উল্লেখযোগ্য, এবং খামখেয়ালের দ্বারা সীমিত হলেও তার জ্ঞান এত অসাধারণভাবে প্রচুর ও সূক্ষ্ম যে তার অনেক বক্তব্যই আমাকে বিস্মিত করেছে। কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য সম্মুখে না থাকলে কোন মানুষ এত কঠিন পরিশ্রম করতে বা এত নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না। যারা আবোলতাবোল পড়াশুনা করে তাগের জ্ঞান কদাচিৎ সঠিক হয়ে থাকে। স্পষ্ট কারণ না থাকলে কোন মানুষ ছোটখাট বিবরণ সংগ্রহ করে মনকে বোঝাই করে রাখতে পারে না।