বেশ জোরের সঙ্গে আমার হাত চেপে ধরে সে সাদরে বলল, ‘কেমন আছেন? মনে হচ্ছে, আপনি আফগানিস্থানে ছিলেন?’
‘সেকথা আপনি জানলেন কেমন করে?’ আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
মুচকি হেসে সে বলল, ‘ও কথা থাক।’ এখন সমস্যাটা হচ্ছে হিমোগ্লোবিন নিয়ে। আমার এই নতুন আবিষ্কারের গুরুত্ব আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?’
আমি জবাব দিলাম, ‘রসায়নের দিক থেকে নিঃসন্দেহে ইণ্টারেস্টিং, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে—‘
‘বলেন কি? চিকিৎসা-আইনের ক্ষেত্রে এতবড় আবিষ্কার গত কয়েক বছরের মধ্যে হয় নি। আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে রক্তের দাগের বিষয়ে আমরা একটা অভ্রান্ত পরীক্ষা পেয়ে যাচ্ছি। চলুন তো ওখানে!’ আগ্রহের আতিশয্যে আমার কোটের আস্তিন চেপে ধরে যে টেবিলে সে কাজ করছিল সেখানে আমাকে টেনে নিয়ে গেল। ‘কিছুটা তাজা রক্ত নেওয়া যাক,’ বলে একটা লম্বা ভোঁতা সূঁচ আঙুলে ঢুকিয়ে দিল, আর ফোঁটা কয়েক রক্ত একটা পাত্রে ধরে নিল। ‘এবার এইটুকু রক্ত এক লিটার জলে মিশিয়ে দিলাম। দেখতে পাচ্ছেন, মিশ্রণটার রঙ বিশুদ্ধ জলের মত হয়ে গেল। এতে রক্তের অনুপাত দশ লক্ষে একের বেশী হবে না।’ কথা বলতে বলতে সে ঐ পাত্রে কয়েক টুকরো সাদা স্ফটিক ফেলে দিয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা স্বচ্ছ তরল পদার্থ যোগ করল। দেখতে দেখতে মিশ্রণটায় মেহগেনি রঙ ধরল, আর কাঁচের পাত্রটার নীচে কিছু বাদামী রঙের তলানি পড়ল।
‘হাঃ! হাঃ!’ সে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল, যেন ছোট শিশু একটা নতুন খেলনা পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। ‘এটা কি বলুন তো?’
‘একটা কোন সূক্ষ্ম পরীক্ষা বলে মনে হচ্ছে,’ আমি বললাম।
‘সুন্দর! সুন্দর! পুরনো “গুয়াইকাম” পরীক্ষাটা যেমন গোলমেলে তেমনি অনিশ্চিত। রক্ত কণিকার অনুবীক্ষণিক পরীক্ষাটাও তাই। রক্তের দাগটা কয়েক ঘণ্টা পুরনো হয়ে গেলে তো পরের পরীক্ষাটা একেবারেই মূল্যহীন। অথচ এই পরীক্ষাটা তাজা বা বাসি উভয় রক্তের বেলায়ই সমান কার্যকরী। এই পরীক্ষাটা যদি আগে আবিষ্কৃত হত, তাহলে শত শত লোক যারা আজও পৃথিবীর মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা অনেক আগেই তাদের কৃত অপরাধের শাস্তি ভোগ করত।’
‘সত্যি!’ আমি আস্তে আস্তে বললাম।
‘খুনের মামলাগুলি ক্রমাগত একটি পয়েণ্টের উপরই ঝুলে থাকে। হয় তো খুনের কয়েক মাস পরে একটা লোকের উপর সন্দেহ পড়ল। তার কাপড়-চোপড় পরীক্ষা করে বাদামী দাগ পাওয়া গেল। সেগুলো রক্তের দাগ, কাদার দাগ, মরচের দাগ, ফলের দাগ, না আর কিছু? এই প্রশ্ন অনেক বিশেষজ্ঞকেই বিচলিত করেছে। কিন্তু কেন? কারণ, কোন নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা-ব্যবস্থা ছিল না। এবার “শার্লক হোমস পরীক্ষা”টা পাওয়া গেল, সুতরাং আর কোন অসুবিধা রইল না।’
কথা বলার সময় তার চোখ চকচক করছিল। বুকের উপর হাত রেখে সে এমনভাবে মাথা নীচু করল যেন কল্পনার চোখে দেখা এক সপ্রশংস জনতাকে অভিবাদন জানাচ্ছে।
তার উৎসাহ দেখে বিস্মিত হয় আমি বললাম, ‘আপনাকে অভিবাদন জানানো উচিত।’
‘গত বছর ফ্রাংকফোর্টে ভন বিস্কর্ফের কেসটাই ধরুন। এ পরীক্ষাটা তখন চালু থাকলে নির্ঘাৎ তার ফাঁসি হত। আরও ধরুন, ব্রাডফোর্ডের ম্যাসন, কুখ্যা মুলার; মঁৎপেলিয়ের-এর লেফেভার এবং নিউ অর্লিয়ান্সের স্যামসন। এ রকম আরও এককুড়ি কেসের কথা আমি বলতে পারি যেখানে এই পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে অপরাধের প্রমাণ হতে পারত।’
স্ট্যামফোর্ড হেসে বলল, ‘আপনি দেখছি অপরাধের একটি জীবন্ত পঞ্জিকা। এবিষয়ে আপনি একখানি পত্রিকা বের করতে পারেন। তার নাম দিন “অতীতের পুলিশী সমাচার”।’
আঙুলের মাথায় একটুকরো প্লাস্টার জড়াতে জড়াতে শার্লক হোমস বলল, ‘পত্রিকাটিকে খুব কৌতূহলোদ্দীপক করা যায় কিন্তু।’ তারপর হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, ‘কিন্তু আমাকে সাবধান হতে হবে। কারণ আমাকে নানারকম বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়।’ সে তার হাতখানা বাড়িয়ে ধরল। দেখলাম, তার সারা হাত কড়া এসিডে বিবর্ণ হয়ে গেছে এবং তাতে আগাগোড়া টুকরো টুকরো প্লাস্টার জড়ানো।
একটা তিন-পায়া উঁচু টুলে নিজে বসে আর একটা টুল পা দিয়ে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে স্ট্যামফোর্ড বলল, ‘একটা কাজে আমরা এসেছি। আমার এই বন্ধু একটা আস্তানা খুঁজছেন। আপনি বলেছিলেন একজন অংশীদার খুঁজে পাচ্ছেন না, তাই আপনাদের দুজনকে দেখা করিয়ে দিলাম।’
আমার সঙ্গে এক বাসায় থাকার প্রস্তাবে শার্লক হোমসকে খুশিই মনে হল। বলল, ‘বেকার স্ট্রীটে একটা “সুইট” দেখেছি। আমাদের দুজনের বেশ কুলিয়ে যাবে। আশা করি তামাকের কড়া গন্ধে আপনার আপত্তি হবে না?’
জবাব দিলাম, ‘আমি নিজেও ধূমপান করি।’
‘তাহলে তো ভালই হল। নানারকম রাসায়নিক পদার্থ আমার কাছে থাকে। মাঝে মাঝে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। তাতে আপনার অসুবিধা হবে না তো?’
‘মোটেই না।’
‘ভেবে দেখি—আমার আর কি দোষ আছে। মাঝে মাঝে আমি চুপচাপ থাকি, পরপর কয়েকদিন হয় তো মুখই খুলি না। তখন যেন মনে করবেন না যে আমি খুব রেগে আছি। স্রেফ আমাকে একা থাকতে দেবেন, ব্যাস সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার আপনার কি বলার আছে বলুন। একসঙ্গে থাকবার আগে দুজনেরই পরস্পরের দোষ-ত্রুটিগুলি জানা থাকা ভাল।’
তার জেরায় আমি হেসে উঠলাম। বললাম, ‘আমার একটা কুকুরের বাচ্চা আছে। আমার স্নায়ুগুলো খুব দূর্বল হয়ে পড়েছে, তাই হট্টগোল পছন্দ করি না। সময়ে অসময়ে ঘুম থেকে উঠি। আলসেমি করি। ভাল অবস্থায় আরও কিছু কিছু দোষ আছে, তবে আপাতত ঐগুলিই প্রধান।’