শার্লক হোমস একটা লম্বা নিঃস্বাস ফেলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ‘নিজের উপরে আরও বিশ্বাস রাখা উচিত ছিল। একটা বিশেষ ঘটনা যদি একটা র্দীঘ অনুমান-শৃংখলের বিরোধী হয়, তাহলে সে ঘটনাটির অন্য কোন ব্যাখ্যা যে অবশ্যই পাওয়া যাবে—এতদিনেও সেটা অন্তত আমার জানা উচিত। ঐ বাক্সের দুটো বড়ির একটা ছিল মারাত্মক বিষ, অন্যটা ছিল সম্পূর্ণ অক্ষতিকর। বাক্সটা দেখবার আগেই এটা আমার বোঝা উচিত ছিল।’
এই সর্বশেষ বক্তব্যটি এতই চাঞ্চল্যকর যে তার বুদ্ধি-শুদ্ধি ঠিক আছে কিনা সেবিষয়ে সন্দেহ হতে লাগল। অবশ্য মৃত কুকুরটা প্রমাণ করছে যে তার অনুমানই যথার্থ, আমার মনের কুয়াসাও যেন ক্রমেই কেটে যাচ্ছে। আমি যেন সত্যের একটা অস্পষ্ট অনুভূতি লাভ করেছি।
হোমস বলতে লাগল, ‘এইসব তোমাদের কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে, কারণ তদন্তের একেবারে শুরুতেই যে একমাত্র প্রকৃত সূত্রটি তোমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিল তার গুরুত্ব তোমরা বুঝতে পারনি। সৌভাগ্যবশত সেটাকে আমি ধরতে পেরেছিলাম, এবং তারপর থেকে যা কিছু ঘটেছে সবই আমার মূল ধারণাকে সমর্থন তো সে করেছেই, বরং সে সবই তার ন্যায়সঙ্গত পরিণতি। কাজেই যেসব ব্যাপার তোমাদের বিচলিত করেছে এবং কেসটাকে আরও জটিল করে তুলেছে, সেগুলিই আমাকে দেখিয়েছে আলো, আমার সিদ্ধান্তকে করেছে দৃঢ়তর। বিস্ময়করতাকে রহস্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা একটা মস্ত বড় ভুল। সবচাইতে সাধারণ অপরাধই প্রায়শঃ সবচাইতে রহস্যময় হয়ে থাকে, কারণ তাতে এমন কোন নতুন বা বিশেষ লক্ষণ থাকে না যার থেকে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এক্ষেত্রেও মৃতের দেহটা যদি রাস্তায় পাওয়া যেত, যে সমস্ত ভয়ংকর ও উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা-সমাবেশ সমস্ত ব্যাপারটাকে উল্লেখযোগ্য করে তুলেছে সেসব কিছুই যদি না থাকত, তাহলে এই খুনের রহস্যভেদ করা আরও অনেক বেশী কষ্টসাধ্য হত। এই সব বিস্ময়কর ঘটনার সমাবেশ কেসটাকে কষ্টসাধ্য করার বদলে বরং সহজসাধ্য করে তুলেছে।’
মিঃ গ্রেগসন যথেষ্ট ধৈর্যসহকারে এই ভাষণ শুনছিল। কিন্তু আর সে নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। বলে উঠল, ‘দেখুন মিঃ র্শালক হোমস, আমরা সকলেই স্বীকার করছি যে আপনি খুব চতুর লোক, আপনার কাজের একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। কিন্তু এখন আমরা শুধু থিওরি আর ভাষণের চাইতেও বেশী কিছু চাই। কথা হচ্ছে, আসল লোকটি কে। আমার কথা বলেছি। দেখছি, আমার ভুল হয়েছিল। যুবক চার্পেণ্টিয়ার দ্বিতীয় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না। লেস্ট্রেড ছুটেছিল স্ট্যাঙ্গারসনের পিছনে। দেখা যাচ্ছে, তারও ভুল হয়েছিল। আপনি এখানে কিছু ইঙ্গিত করেছেন, ওখানে কিছু ইঙ্গিত করেছেন, মনে হচ্ছে, আমাদের চাইতে বেশিই আপনি জানেন। কিন্তু এখন আমরা সরাসরি জানতে চাই, এ বিষয়ে আপনি কতটা জানেন। এ কাজ কে করেছে তার নাম কি আপনি বলতে পারেন?’
লেস্ট্রেড বলল, ‘আমারও অভিমত যে গ্রেগসন ঠিকেই বলেছে স্যার।’ আমরা দুজনই চেষ্টা করে বিফল হয়েছি। আমি ঘরে ঢুকবার পরে আপনি একাধিকবার বলেছেন যে আপনি সেগুলি আর চেপে রাখবেন না’
আমি বললাম, ‘আততায়ীর গ্রেপ্তার বিলম্বিত হলে সে নতুন কোন দুষ্কর্মের সুযোগ পেতে পারে।’
এইভাবে সকলে চেপে ধরায় হোমস অস্থিরভাবে ঘরের এদিক-ওদিক হাঁটটে লাগল। মাথাটা বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছে, ভুরু দুটো নেমে এসেছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেই তার এরকম হয়।
হঠাৎ থেমে আমাদের সামনে এসে সে বলে উঠল, ‘আর খুন হবে না। সে সম্ভাবনা একেবারেই বাতিল করে দিতে পার। তোমরা জানতে চেয়ছ, হত্যাকারীর নাম আমি জানি কি না। জানি। শুধু নাম জানাটা কিছু নয়, আসল কথা হচ্ছে তাকে পাকড়াও করা। আশা করছি অতি শীঘ্রেই সেটা পারব। যথেষ্ট আশা আছে যে আমার নিজের ব্যবস্থাপনায়ই সেটা সম্পন্ন হবে। কিন্তু খুব সর্তকতার সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে, কারণ একটি খুব সুচতুর ও বেপরোয়া লোকের সঙ্গে আমাদের যুঝতে হবে, এবং আমি প্রমাণ পেয়েছি যে তার এমন একজন সঙ্গী আছে যে তার মতই চতুর। কেউ তার খোঁজ পেয়েছে এটা যতক্ষণ সে না জানতে পারবে ততক্ষণই তাকে পাকড়াও করবার কিছুটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তিলমাত্র সন্দেহ বোধ করলেই সে নাম পাল্টে এই মহানগরীর চল্লিশ লক্ষ লোকের মধ্যে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আপনাদের মনে কোনরকম আঘাত দেবার ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু একথা বলতে আমি বাধ্য যে দুটি লোকের মহড়া নেবার সামর্ত্য সরকারী পুলিশ বাহিনীর নেই, আর সেইজন্যই আপনাদের সহায়তা আমি চাই নি। আমি বিফলকাম হলে অবশ্য আপনাদের বাদ দেওয়ার দায়ভাগ আমাকে বহন করতে হবে। আর সেজন্য আমি প্রস্তুতও আছি। বর্তমানে আমি এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে আমার ব্যবস্থাকে বিপন্ন না করে যখনই আপনাদের সব কথা জানান সম্ভব হবে সেই মূহুর্তেই তা জানিয়ে দেব।’
এই প্রতিশ্রুতিতে বা গোয়েন্দা পুলিশ সম্পর্কে নিন্দাসূচক উল্লেখে গ্রেগসন বা লেস্ট্রেড কাউকেই সন্তুষ্ট মনে হল না। গ্রেগসনের মুখ, তার হলদে চুলের গোড়া পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল, আর লেস্ট্রেডের ক্ষুদে চোখ দুটি কৌতুহলে ও ক্ষোভে চকচক করতে লাগল। কেউ কোন কথা বলবার আগেই দরজায় একটা টোকা পড়ল এবং বাউন্ডুলে ছেলেদের দলপতি উইগিন্স ঘরে ঢুকল।
মাথার সামনেকার চুলে হাত রেখে সে বলল, ‘স্যার, নীচে গাড়িখানা রেখেছি।’