খুনির বিবরণ শুনে আমি আড়-চোখে হোমসের দিকে তাকালাম, কারণ তার নিজের বিবরণের সঙ্গে এটা হুবুহু মিলে গেছে। তার মুখে কিন্তু উল্লাস বা সন্তুষ্টির চিহ্নমাত্র নেই।
সে প্রশ্ন করল ‘খুনিকে ধরবার সূত্র পাওয়া যায় এরুপ কোন কিছুই কি ঘরের মধ্যে দেখনি?’
‘কিচ্ছু না। ড্রেবারের টাকার থলিটা স্ট্যাঙ্গারসনের পকেটে ছিল। এটা তো খুবই স্বাভাবিক। কারণ দেনা-পাওনা সব সেই করত। তার মধ্যে আশি পাউন্ড ছিল, কিছুই খোয়া যায়নি। এইসব অসাধারণ অপরাধের উদ্দেশ্য আর যাই হোক ডাকাতি নয়। নিহত লোকটির পকেটে কোন কাগজপত্র বা স্মৃতি-লেখা ছিল না। শুধু ছিল একটা টেলিগ্রাম। ক্লিভল্যান্ডে এক মাস আগের তারিখ দেওয়া। তাতে লেখা, ‘জে, এইচ, ইওরোপে আছে।’নীচে কোন নাম লেখা নেই।’
‘আর কিছুই ছিল না?’ হোমস প্রশ্ন করল।
গুরুত্বপূর্ণ কিছুই না। লোকটি যে উপন্যাসখানা পড়তে পড়তে ঘুমিয়েছিল সেখানা বিছানার উপর পড়েছিল । আর তার পাইপটা ছিল পাশেই চেয়ারের উপর। টেবিলের উপর এক গ্লাস জল ছিল, আর জানালার গোবরাটের উপর ছিল একটা টুকরো মলমের বাকস তাতে গোটা দু্ই বড়ি।’
আনন্দে চীৎকার করে শালক হোমস চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল।
‘শেষ সূত্র’,উল্লাসে চীৎকার করে সে বলল, এবার ‘আমার কেস সম্পূর্ণ হল।’
দুই গোয়েন্দা সবিস্ময়ে তারঁ দিকে তাকিয়ে রইল। আমার সঙ্গী আত্ন-বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে লাগল,‘যে-সব সুতো মিলে এমন একটা জট পাকিয়েছিল, তার সবগুলোকে এখন হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছি।যদিও কিছু কিছু টুকরো ঘটনা এখনও তার মধ্যে ঢোকাতে হবে, তথাপি স্টেশনে ড্রাইবার এবংস্ট্যাঙ্গারসন পরস্পর থেকে বিচ্চিন্ন হবার পর থেকে স্ট্যাঙ্গারসনের মৃতদেহ আবিষ্কার পযর্ন্ত সবগুলি প্রধার ঘটনা সম্পর্কে আমি এতই নিশ্চিত যেন সেগুলোকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার জ্ঞানের একটা প্রমাণ তোমাকে দিচ্ছি। সেই বড়িগুলো তোমার কাছে আছে কি?’
একটা ছোট সাদা বাক্স বের করে লেস্ট্রেড বলল,‘থানায় গিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় রাখবার জন্য মলমের বাক্স,টাকার থলি আর টেলিগ্রামখানা আমি নিয়ে এসেছি। কিছু না ভেবেই বড়িগুলো আমি নিয়ে এসেছি,কারণ সত্যি বলছি ওগুলোর উপর কোন গুরুত্বই আরোপ করছি না।
হোমস বলল, ‘ওগুলো আমাকে দাও দেখি।’তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ডাক্তার ,এগুলো কি সাধারণ বড়ি?’
সাধারণ মোটেই নয়। মুক্তোর মত রং, ছোট গোল, স্বচ্ছ। আমি বললাম,‘এগুলো এত হাল্কা এবং স্বচ্ছ যে জলে ফেললে গলে যাবে বলে মনে হয়।’
হোমস বলল, ঠিক তাই। দয়া করে নীচে গিয়ে টেরিয়ারটাকে নিয়ে আসবে কি?ওটা তো অনেকদিন থেকেই ভুগছে, আর গৃহকর্মীও তোমাকে কালই বলেছে ওটাকে সব যন্তণার হাত থেকে রেহাই দিতে।’
আমি নীচে গিয়ে কুকুরটাকে কোলে করে নিয়ে এলাম। তার শ্বাসকষ্ট আর ঝকঝকে চোখ দেখেই মনে হল, ওর শেষের দিন আর বেশী দেরী নেই। ওর বরফের মত সাদা নাকই ঘোষণা করছে যে কুকুর –জীবনের আয়ুষ্কাল ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। কম্বলের উপর একটা কুশনে ওটাকে রাখলাম।
‘এইবার একটা বড়িকে দুটুকরো করে কাটছি,’বলে হোমস একখানা কলমকাটা ছুরি বের করে কথামতকাজ করল। ‘ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য অর্ধেকটা বাক্রসেই রেকে দিলাম। বাকি অর্ধেকটা এক চামচ জল-ভরা এই মদের গ্লাসে ফেললাম। দেখ, আমার ডাক্তার বন্ধুটি ঠিকই বলেছ্। সঙ্গে সঙ্গে বড়িটা গলে গেল। ‘
কাউকে উপহাস করলে সে যেরকম আহত হয় সেই-রকম ক্ষূধ্ব গলায় লেস্ট্রেড বলল, ‘ব্যাপারটা দেখতে ভালই, কিন্তু জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসনের মৃত্যুর সঙ্গে এর কি সর্ম্পক আমি তো বুঝতে পারছি না।’
‘র্ধৈয, বন্ধু, র্ধৈয! যথাসময়েই দেখতে পাবে সর্ম্পক খুবই ঘনিষ্ঠ। মিশ্রণটাকে স্বাদু করবার জন্য একটু দুধ মিশিয়ে কুকুরটার সামনে ধরলেই ও সবটা চেটে খেয়ে ফেলবে।’
বলতে বলতে সে মদের গ্লাসের মিশ্রণটা একটা পাত্রে ঢেলে টেরিয়ারটার সামনে ধরতেই সে চটপট সেটাকে খেয়ে ফেলল। র্শালক হোমসের এতাগ্রতা আমাদের উপর এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে আমরা নিঃশব্দে বসে জন্তুটাকে দেখছিলাম আর বিস্ময়কর কোন ফলের প্রত্যাশা করছিলাম্। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না।কুকুরটা কুশনের উপর টান-টান হয়ে শ্বাস টানতে লাগল। কিন্তু ঐপানীয় পান করার ফলে তার মধ্যে ভাল বা মন্দ কোন লক্ষণই দেখা গেল না।
হোমস ঘড়ি বের করে দেখছে। মিনিটের পর মিনিট বিফলে কেটে যাচ্ছে। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ ও হতাশার ছায়া পড়ছে। সে ঠোঁট কামড়াচ্ছে, আঙুল দিয়ে টেবিলে টোকা দিচ্ছে, একে একে তীব্র অধৈর্যের সব লক্ষণই তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। সে এতই মুষড়ে পড়ছে। যে তার জন্য সত্যই আমার দুঃখ হচ্ছিল। কিন্তু সে যে শেষ পর্যন্ত একটা ধাক্কা খেয়েছে তাতে গোয়েন্দা-যুগল অখুশি তো নয়ই বরং মিটি-মিটি হাসছে।
অবশেষে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ঘরময় দ্রুতবেগে পায়চারি করতে করতে সে বলে উঠল, ‘এটা আকস্মিক যোগাযোগ হতে পারে না। আকস্মিক যোগাযোগ হওয়া অসম্ভব। ড্রেবারের ক্ষেত্রে যে বাড়ির সন্দেহ আমি করে—ছিলাম, স্ট্যাঙ্গারসনের মৃত্যু পরে সেই একই বাড়ি পাওয়া গেছে। অথচ ওগুলো তো জড় পদার্থ। এর কি অর্থ হতে পারে। আমার যুক্তি-শৃঙ্খলটা আগাগোড়াই ভ্রান্ত হতে পারে না। অসম্ভব! অথচ এই হতভাগ্য কুকুরটার কিছুই ছিল হল না। ও হো, পেয়েছি! পেয়েছি! আনন্দে চীৎকার করে উঠে সে বাক্সটার কাছে ছুটে গেল, অন্য একটি বাড়ি কেটে জলে গুলে দুধে মেশাল। টেরিয়ারটার সামনে ধরতেই হতভাগ্য জন্তুটা সেই পানীয়ে ঠোঁট ভেজাতে না ভেজাতেই তার সারা দেহটা থরু থর করে কেঁপে উঠেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত নির্জ্জীব হয়ে গেল।