‘তারপর?’
‘তাকে চলে যেতে দেখে মনটা হাল্কা হল। ছেলে তখন ছুটিতে এসেছে। এসব কথা কিছুই তাকে জানালাম না। কারণ সে খুব বদরাগী, আর বোনকে খুব ভালবাসে। তারা চলে যেতে আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে মনে হল মনের উপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। কিন্তু হায়! এক ঘণ্টার মধ্যই দরজায় আবার বেল বেজে উঠল। শুনলাম, মিঃ ড্রেবার ফিরে এসেছেন। তিনি খুব উত্তেজিত। মদ খাওয়ার জন্য তাঁর অবস্থা আরও শোচনীয়। যে ঘরে আমি মেয়েকে নিয়ে বসেছিলাম তিনি জোর কর সেই ঘরে ঢুকে ট্রেন পান নি বলে কিছু অবান্তর কথা বললেন। তারপর এলিসের দিকে ফিরে আমার মুখের উপর তাকে বললেন তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে। বললেন, ‘তোমার বয়স হয়েছে, কোন আইন তোমাকে আটকাতে পারে না, আমার অনেক বাড়তি টাকা আছে। ওই বুড়ি মেয়েটার কথা ভেব না। আমার সঙ্গে এখনই সোজা চলে এস। আমি তোমাকে রাণীর মতো রাখব।’ বেচারি এলিস আতংকে ছুটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই তিনি তার হাত ধরে দরজার দিকে টানতে লাগলেন। আমি চীৎকার করে উঠলাম, আর সেই মুহূর্তে আমার ছেলে আর্থার ঘরে ঢুকল। তারপর কি ঘটল আমি জানি না। আমি নানারকম কটুক্তি ও ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দ শুনেছিলাম। কিন্তু ভয়ে মুখ তুলতে পারি নি।যখন মুখ তুললাম তখন দেখি একটা লাঠি হাতে নিয়ে আর্থার দাঁড়িয়ে হাসছে। আমাকে সে বলল, ‘ভদ্রলোক আর কখনও আমাদের বিরক্ত করবে না। একবার গিয়ে দেখতে হবে তিনি কি করেন।’ বলতে বলতে টুপিটা নিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। পরদিন মিঃ ড্রেবারের রহস্যজনক মৃত্যুর খবর শুনলাম।’
‘অনেকবার ঢোঁক গিলে থেমে থেমে ম্যাডাম চার্পেস্টিয়ার যা বলছিলেন হল সেই বিবরণ। সময় সময় সে এত নীচু স্বরে কথা বলছিল যে সব শোনও যায়নি। আমি অবশ্য তার সব কথারই শর্ট-হ্যান্ড নোট নিয়েছি, যাতে কোনরকম ভুলের সম্ভাবনা না থাকে।’
শার্লক হোমস হাই তুলে বলল, ‘খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। তারপর কি হল?’
গোয়েন্দা বলতে লাগলেন, ‘ম্যাডাম চার্পেস্টিয়ার থামল। আমি বুঝতে পারলাম সমস্ত ব্যাপারটা একটা পয়েন্টের উপর নির্ভর করছে। একদৃষ্টিতে স্ত্রীলোকটির চোখের দিকে তাকালাম। মেয়েদের ব্যাপারে এটা অনেক সময় খুব কার্যকারী হয়। জানতে চাইলাম, তার ছেলে কখন ফিরেছিল।’
‘আমি জানি না,’ সে জবাব দিল।
‘জানেন না?’
‘না। তার কাছে একটা চাবি থাকে। সেটা দিয়ে দরজা খুলে সে নিজেই বাড়িতে ঢোকে।’
‘আপনি শুতে যাবার পরে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কখন শুতে গিয়েছিলেন?’
‘এগারোটায়।’
‘অর্থাৎ আপনার ছেলে দুঘণ্টা বাইরে ছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘চার বা পাঁচ ঘণ্টাও হতে পারে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এত সময় সে কি করছিল?’
‘আমি জানি না।’ সে জবাব দিল। তার ঠোঁট তখন সাদা হয়ে গেছে।
‘অবশ্য এর পরে আর সেখানে কিছু করবার ছিল না। লেফটেন্যান্ট চার্পেন্টিয়ার কোথায় আছে খোঁজ করে দুজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলাম এবং তাকে গ্রেপ্তার করলাম। তার কাঁধে হাত রেখে যখন তাকে নিঃশব্দে আমাদের সঙ্গে আসতে বললাম, সে উদ্ধৃত সাহসের সঙ্গে বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে ঐ পাজী ড্রেবারের মৃত্যুর জন্য আমাকে গ্রেপ্তার করছেন।’ তখনও আমরা তাকে কিছুই বলি নি। তাই তার পক্ষে ওকথা উল্লেখ করায় আমাদের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল।’
‘খুবই স্বাভাবিক’ হোমস বলল।
‘সে যখন ড্রেবারের পিছু নেয় তখন তার হাতে যে ভারী লাঠিটা ছিল বলে তার মা উল্লেখ করেছে, সেটা তখনও তার হাতেই ছিল। ওক কাঠের একটা মুগুরবিশেষ।’
‘তাহলে তোমার বক্তব্যটা কি?’
‘দেখুন, আমার বক্তব্য সে ব্রিক্সটন রোড পর্যন্ত ড্রেবারকে অনূসরণ করে। সেখানে পৌঁছে দুজনের মধ্যে আবার ঝগড়া বাঁধে। সেইসময় ড্রেবারের পেটে লাঠির আঘাত লাগে এবং সে মারা যায়, কিন্তু আঘাতের কোন চিহ্ন মৃতদেহে পড়ে না। বৃষ্টির রাত। কেউ কোথাও ছিল না। চার্পেন্টিয়ার মৃতদেহটাকে টানতে টানতে খালি বাড়িতে নিয়ে যায়। আর মোমবাতি, রক্ত, দেওয়ালের লেখা, এবং আংটি—এসবই পুলিশকে ভুল পথে চালাবার ধোঁকা হতে পারে।’
উৎসাহ দেওয়ার ভঙ্গীতে হোমস বলল, ‘চমৎকার! সত্যি গ্রেগসন, বেশ ভালই চালাচ্ছ। তোমাকে আরও বড় কিছু না বানিয়ে ছাড়ছি না।’
গোয়েন্দা গর্বভরে বলল, ‘সমস্ত ব্যাপারটা বেশ ভালভাবে গুছিয়ে এনেছি বলে আমার খুব গর্ব হচ্ছে। যুবকটি স্বেচ্ছায় একটা বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে, কিছুদুর পযন্ত ড্রেবারকে অনুসরণ করবার পর ড্রেবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য একটা গাড়িতে উঠে পড়ে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরবার পথে একটা পুরনো জাহাজী বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয় এবং তার সঙ্গে সে অনেকটা পথ হাঁটে। সেই পুরনো জাহাজী বন্ধু কোথায় থাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারে না। আমার তো মনে হয় সব ব্যাপারটাই গাঁটে গাঁটে মিলে যাচ্ছে। লেস্ট্রেড যে ভুল পথে ঘুরে মরছে সেটা ভেবেই আমার আরও বেশী মজা লাগছে। আমার ধারণা, সে বেশী দূর এগোতেও পারবে না। আরে! সে যে সশরীরে হাজির।’
সত্যি লেস্ট্রেড। আমার যখন কথা বলছিলাম তখন সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে। এবার ঘরে ঢুকল। তার হাবভাব এবং পোশাকে সাধারণতঃ যে আড়ম্বর থাকে সেটার যেন অভাব দেখা গেল। তার মুখে বিরক্তি ও গোলযোগের আভাষ। তার পোশাক এলোমেলো ও ময়লা। স্পষ্টই বোঝা গেল, সে শালর্ক হোমসের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছিল। সহকর্মীকে দেখেই কেমন যেন বিব্রত ও মুহ্যমান হয়ে পড়ল। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি করবে বুঝতে না পেরে টুপিটা হাতাতে লাগল। অবশেষে বলল, ‘একটা অসাধারণ কেস—একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার।’