আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘সে যদি বাসার এবং ভাড়ার এজজন অংশীদার সত্যিই চায়, তাহলে আমিই সেই লোক। সঙ্গীহীন থাকার চাইতে একজন অংশীদার আমারও পছন্দ।’
মদের পাত্রের উপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্ট্যামফোর্ড বলল, ‘শার্লক হোমসকে তুমি এখনও চেন না। স্থায়ী সঙ্গী হিসাবে তুমি হয় তো তাকে পছন্দ করবে না।‘
‘কেন? তার বিরুদ্ধে কি বলবার আছে?’
‘না, এর কোন দোষের কথা আমি বলছি না। তবে তার চিন্তাভাবনাগুলো একটু অদ্ভুত ধরনের—বিজ্ঞানের কতকগুলি শাখায় বেশ উৎসাহী। আমি যতদূর জানি, লোকটি বেশ ভদ্র।’
‘ডাক্তারী ছাত্র নিশ্চয়’, আমি বললাম।
‘না—সে যে কি হতে চায় সেবিষয়ে আমার কোন ধারণাই নেই। আমার বিশ্বাস সে শরীর-সংস্থান বিদ্যায় বেশ পারদর্শী। একজন প্রথম শ্রেণীর রসায়নবিদও বটে। কিন্তু আমি যতদূর জানি সে কোনকালে নিয়মিত কোন ডাক্তারীশাস্ত্রের পাঠ নেয় নি। তার পড়াশুনাও অত্যন্ত আগোছালো আর খামখেয়ালি। কিন্তু নানা বিষয়ে জ্ঞান সে এত সঞ্চয় করেছে যে তার অধ্যাপকদেরও তাক লেগে যায়।’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কি কোনদিন জানতে চাও নি সে কি হতে পারে?’
‘না। তার মনের হদিস করা সোজা কাজ নয়। তবে খেয়াল জাগলে তার মুখে কথার খই ফোটে।’
আমি বললাম, ‘তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। যদি কারও সঙ্গেই বাস করতে হয়, আমি পড়াশুনা-করা চুপচাপ লোকই পছন্দ করি। অত্যধিক গোলমাল বা উত্তেজনা সহ্য করবার মত শক্তি এখনও ফিরে পাই নি। ও দুটো বস্তুই আফগানিস্থানে এত বেশী পেয়েছিলাম যে আর যতদিন বেঁচে থাকব ওতেই চলে যাবে। তোমার ওই বন্ধুর সঙ্গে কেমন করে দেখা হতে পারে?’
সঙ্গী উত্তরে বলল, ‘নিশ্চয় সে লেবরেটরিতে আছে। হয় সে সপ্তাহের পর সপ্তাহ সে স্থানই মাড়ায় না, আর না হয় তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে কাজ করে। তুমি চাও তো খাওয়া শেষ করে একসঙ্গেই সেখানে পারি।’
‘নিশ্চয় যাব’ আমি বললাম। তারপরই আলোচনা অন্য পথে মোড় নিল।
যে ভদ্রলোকের সহ-বাসিন্দা হবার প্রস্তাব এইমাত্র করলাম, হোলবর্ণ থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে যাবার পথে তার সম্পর্কে আরও কিছু বিবরণ স্ট্যামফোর্ড আমাকে জানান। বলল, ‘তার সঙ্গে যদি মানিয়ে চলতে না পার, তাহলে কিন্তু আমাকে দোষ দিও না। মাঝে মাঝে লেবরেটরিতে দেখা-সাক্ষাতের ফলে তার যেটুকু পরিচয় পেয়েছি তার বেশী কিছু আমি জানি না। তুমিই এক প্রস্তাব করেছ, কাজেই আমাকে যেন দায়ী করো না।’
আমি বললাম, ‘মানিয়ে চলতে না পারলে সরে গেলেই হবে। তারপর সঙ্গীর দিকে একটু কড়া চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘দেখ স্ট্যামফোর্ড, মনে হচ্ছে বিশেষ কোন কারণে তুমি এ ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে চাইছ না। লোকটির মেজাজ খুব খাপ্পা নাকি? না আর কিছু? রেখে-ঢেকে কথা বলো না।’
সে হেসে বলল, ‘অনির্বচনীয়কে ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নয়। আমার বিচারে হোমস একটু অতি-বৈজ্ঞানিক ধাতের লোক—প্রায় অনুভূতিহীন। অনিষ্টসাধনের উদ্দেশ্য নয়, শুধুমাত্র ফলাফল সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের গবেষণার খাতিরেই সে তার বন্ধুকে একচিমটে উদ্ভিজ্জ উপক্ষার ক্ষেতে দিচ্ছে, তাও কল্পনা করা যায়। তার প্রতি সুবিচার করতে হলে বলতে হয়, ওই একই কারণে সমান তৎপরতার সঙ্গে সে নিজেও ওটা খেতে পারে। নির্দিষ্ট ও সঠিক জ্ঞানার্জনের প্রতি তার একটা নেশা আছে বলে মনে হয়।’
‘এটা তো খুব ভালো কথা।’
‘ভাল, তবে বাড়াবাড়ি ঘটতে পারে। যখন কেউ ব্যবচ্ছেদ-কক্ষে মৃত প্রাণীকে লাঠি দিয়ে পিটাতে শুরু করে, তখন সে ব্যাপারটা বড়ই কিম্ভুতকিমাকার হয়ে ওঠে।’
‘মৃত প্রাণীকে লাঠির বাড়ি!’
‘হ্যাঁ। মৃত্যুর পরে শরীরে আঘাতের দাগ কতটা পড়ে সেটা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য তাকে এরকম করতে আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
‘তারপরেও তুমি বলছ, সে মেডিক্যালের ছাত্র নয়?’
‘না। ইশ্বর জানেন তার পড়াশুনার উদ্দেশ্য কি। কিন্তু আমরা তো এসে পড়েছি। তার সম্পর্কে নিজেই তোমার ধারণা গড়ে নিও।’ বলতে বলতে একটা সংকীর্ণ গলিতে মোড় নিয়ে ছোট পাশের দরজার ভিতর দিয়ে হাসপাতালের একটা অংশে প্রবেশ করলাম। এ জায়গা আমার পরিচিত। বিনা সাহায্যেই ঠাণ্ডা পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে লম্বা বারান্দা ধরে এগোতে লাগলাম। দুই পাশে সাদা দেওয়াল আর বাদামী দরজার সারি। প্রায় শেষ প্রান্তে নীচু খিলানওয়ালা যে পথটা বেরিয়ে গেছে সেটা ধরে এগিয়ে গেলেই কেমিক্যাল ল্যাবরেটারি।
উঁচু ঘর। চারদিকে অসংখ্য বোতল। কতক সাজানো, কতক ছড়ানো। এখানে-সেখানে চওড়া নীচু টেবিল। তার উপর বকযন্ত্র, টেস্ট-টিউব আর ছোট বুনসেন বাতি, তার থেকে নীল কাঁপা-কাঁপা শিখা বেরুচ্ছে। ঘরে একটিমাত্র ছাত্র কোণের টেবিলে উপুড় হয়ে কাজ করছে। আমাদের পায়ের শব্দ শুনে যে একবার ফিরে তাকাল। তারপর সোজা দাঁড়িয়ে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। আমার সঙ্গীর দিকে চোখ ফেলে ‘পেয়েছি! পেয়েছি!’ বলে চীৎকার করতে করতে সে একটা টেস্ট-টিউব হাতে নিয়ে আমাদের দিকে ছুটে এল। ‘এমন একটা রি-এজেন্ট আমি পেয়েছি একমাত্র হিমোগ্লোবিন দ্বারাই যার থেকে তলানি পড়ে, আর কিছুর দ্বারাই নয়।‘ একটা সোনার খনি আবিষ্কার করলেও বোধ হয় এর চাইতে বেশী আনন্দে তার চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হত না।
‘ডাঃ ওয়াটসন, মিঃ শার্লক হোমস’, আমাদের দু-জনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে স্ট্যামফোর্ড বলল।