হোমস জবাব দিল, হ্যাঁ। ১২৯, কাম্বারওয়েল রোডের জন আন্ডারউড অ্যান্ড সন্স দ্বারা প্রস্তুত।’
গ্রেগসন যেন খুবই মুষড়ে পড়ল। বলল, ‘আপনিও যে সেটা লক্ষ্য করেছেন তা ভাবি নি। আপনি কি সেখানে গিয়েছিলেন?’
‘না।’
‘হ্যাঁ।’ স্বস্তি ভরা গলায় গ্রেগসন বলল, ‘আপাত দৃষ্টিতে যত তু্চ্ছ নয়।’
‘যাহোক, আমি আন্ডারউডের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম ঐ মাপের ও বিবরণের টুপি সে বিক্রি করেছে কি না। খাতাপত্র ওল্টাতেই পেয়ে গেল। টুপিটা সে পাঠিয়েছিল টর্কোয়ে টেরেসের চার্পেন্টিয়ার্স বোডিং এস্টাব্লিমেন্টের মিঃ ড্রেবারকে। সেখানেই তার ঠিকানাটা পেলাম।’
শালক হোমস আপন মনেই বলে উঠল, ‘চতুর—খুব চতুর!’
গোয়েন্দা বলতে লাগল, ‘তারপরই ম্যাডাম চাপেন্টিয়ারের সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে খুবই বিমর্ষ ও বিষণ্ন দেখলাম। তার মেয়েও সেই ঘরেই ছিল—অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে। তার চোখে দুটো লাল। তার সঙ্গে কথা বলবার সময় তার ঠোঁট কাঁপছিল। সেটা আমার নজর এড়ায় নি। তখনই আমার সন্দেহ হল। মিঃ শালক হোমস, আপনি তো জানেন, ঠিক সূত্রটি খুঁজে পেলে মনের কিরকম ভাব হয় স্নায়ুতে কিরকম একটা উত্তেজনা দেখা দেয়। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার প্রাক্তন বোর্ডার ক্লিভল্যান্ডের মিঃ এনক জে, ড্রেবারের রহস্যজনক মৃত্যুর খবর আপনি শুনেছেন কি?’
‘মা ঘাড় নাড়ল। একটা কথাও বলতে পারল না। মেয়েটি কেঁদে উঠল। বুঝলাম, এরা অনেককিছুই জানে।’
‘জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ট্রেন ধরবার জন্য মিঃ ড্রেবার ক’টার সময় আপনাদের এখান থেকে চলে যান?’
‘উত্তেজনাকে চাপা দেবার জন্য ঢোঁক গিলে সে বলল, ‘আটটার সময়। তাঁর সচিব মিঃ স্ট্যাঙ্গারসন বলেছিলেন, দুটো ট্রেন আছে—একটা ৯টা ১৫-তে আর একটা ১১টায়। তিনি প্রথমটাই ধরবেন?’
‘সেই কি তাকে আপনি শেষ দেখেছেন?’
‘প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকটির মুখের ভয়ংকর পরিবর্তন ঘটল। মুখখানা কালিবর্ণ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে অনেক কষ্টে একটিমাত্র শব্দই সে উচ্চারণ করতে পারল ‘হ্যাঁ,-তখনও তার গলায় স্বর ফ্যাঁসফেঁসে অস্বাভাবিক।’
‘কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পরে মেয়েটি শান্ত স্পষ্ট গলায় বলল, ‘মা, মিথ্যার ফল কখনও ভাল হয় না।এই ভদ্রলোকের কাছে সব কথা খুলে বলাই ভাল। মিঃ ড্রেবারকে আমরা আবার দেখেছিলাম।’
‘ঈশ্বর তোকে ক্ষমা করুন।’ দুই হাত শূন্যে তুলে চেয়ারে বসে পরে ম্যাডাম চার্পেন্টিয়ার বলে উঠলো, ‘তোর ভাইকে তুই খুন করেছিস।’
মেয়েটি দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আর্থারও চাইত যে আমরা সত্য কথাই বলি।’
‘আমি বললাম, ‘সব কথাই আমাকে খুলে বল। অর্ধেক বলা না বলার চাইতে খারাপ। তাছাড়া , এ ব্যাপারে আমরা কতটা জানি তাও তো তোমরা জান না।’
‘মা কেঁদে বলল, ‘এলিস, তোর মাথার দিব্যি,তাই হোক।’ আমার দিকে ফিরে বলল, ‘স্যার, আপনাকে আমি সব কথাই বলব। আমার ছেলে এই ভয়ংকর ব্যাপারে জড়িয়ে পড়বে এই আশংকাতেই আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছি তা মনে করবেন না। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার শুধু ভয়, আপনার চোখে না অন্যদের চোখে তাকে এ ব্যাপারে জড়িত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সেটা একেবারেই অসম্ভব। তার উন্নত চরিত্র, তার জীবিকা, তার অতীত-সবাই এধরনের কাজের পরিপন্থী।’
‘সে বলল, ‘এলিস, আমাদের একটু একা থাকতে দাও।’ মেয়েটি চলে গেল। সে বলতে লাগল, ‘দেখুন স্যার, সব কথা আপনাকে বলবার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু মেয়েটা যখন সব ফাঁস করে দিয়েছে, তখন আর গন্ত্যন্তর নেই। বলাই যখন স্থির করেছি, তখন কিছুই বাদ না দিয়ে সবই আপনাকে বলব।’
‘আমি বলক. সেটাই বুদ্ধিমতীর কাজ।’
‘মিঃ ড্রেবার প্রায় তিন সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি আর তাঁর সচিব মিঃ স্যাঙ্গারসন ইউরোপ পরিভ্রমণে বেরিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকটি ট্যাংকের উপর ‘কোপেনহেগেন’ লেবেল আঁটা দেখেছি। তাতে মনে হয় তারা সর্বশেষ সেখানেই ছিলেন। স্ট্যাঙ্গারসন শান্ত, চাপা প্রকৃতির লোক। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই বলছি, তাঁর মালিক সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মানুষ। তাঁর স্বভাব অমার্জিত, চাল-চলন জানোয়ারের মত। যেদিন ও’রা আসেন সেদিন রাতেই ওরা মদে চুর হয়ে পড়েন। পরদিন বেলা বারোটার আগে তাঁর হুঁস হয় না।পরিচারিকাদের সঙ্গে তাঁর চাল-চলনও দৃষ্টিকটু ও বে-আব্রু। সবচাইতে দুঃখের কথা, আমার মেয়ে এলিসকেও তিনি সেই চোখেই দেখতে শুরু করলেন এবং একাধিকবার তাঁকে এমন সব কথা বললেন, সৌভাগ্যবশত যেগুলো বোঝবার মত বয়স তার এখনও হয় নি। একসময় তিনি হাত ধরে টেনে তাকে আলিঙ্গন পর্যন্ত করেন। তার নিজের সচিব এই অভদ্র আচরণের জন্য তাকে তিরস্কার করতে বাধ্য হন।’
‘আমি প্রশ্ন করলাম, ‘এসব আপনি সহ্য করলেন কেন? যখন খুশি বোর্ডারদের তো আপনি ছাড়িয়ে দিতে পারেন বলে আমি জানি।’
‘আমার প্রশ্নে ম্যাডাম চার্পেম্টিয়ারের মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, ঈশ্বরের কৃপায় তার আসার দিনই তাকে নোটিশ দিলেই ভাল করতাম। কিন্তু লোভ বড় দারুণ জিনিস। দিন প্রতি প্রত্যেকে তারা এক পাউন্ড করে দিচ্ছিলেন—সপ্তাহে চৌদ্দ পাউন্ড। তার উপর এখন খদ্দের-পত্তর কম। আমি বিধবা। ছেলেকে নৌ-বিভাগে পাঠাবার খরচও অনেক। তাই টাকাটা হাতছাড়া করতে মন চাইল না। সবই মেনে নিয়েছিলাম।কিন্তু শেষটায় অত্যন্ত বাড়াবাড়ি হওয়ায় আমি তাকে বাড়ি ছাড়বার নোটিশ দিলাম। তাই তিনি চলে গেলেন।’