‘ডেইলি-নিউজ’-এ বলা হয়েছে, অপরাধটি যে রাজ-নৈতিক সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। স্বৈরাচর ও সমাজতন্ত্রবোধিতা ইউরোপীয় শাসক শক্তিগুলিকে অনুপ্রাণিত করার ফলে এমন বহুলোক আমাদের দেশে চলে এসেছেন যাঁরা অতীত জীবনের তিক্ত স্মৃতির দ্বাড়া তাড়িত না হলে উচ্চশ্রেণীর নাগরিক হতে পারতেন। ঐসব লোকের মধ্যে এমন একটা কঠোর নিয়ম-নিষ্ঠা প্রচলিত ছিল যেকোনরকমভাবে সেটা লঙ্ঘিত হলেই তার শাস্তি ছিল মৃত্যু। সচিব স্ট্যাঙ্গারসনকে খুঁজে বের করতে এবং মৃতের অতীত জীবনের বিবরণ জানাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। যে বাড়িতে তিনি বাস করেছিলেন তার ঠিকানাটা হস্তগত হওয়ায় একটা বড় কাজ হয়েছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মিঃ গ্রেগসনের তীক্ষ্মবৃদ্ধি ও উদ্যমের ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
প্রাতরাশে বসে শার্লক হোমস ও আমি সবগুলিই একত্রে পড়লাম। মনে হল, এগুলি যেন তাকে প্রচুর মজার খোরাক জোগাল।
‘আমি তোমাকে বলেছিলাম, যা কিছুই ঘটুক লেস্ট্রেড আর গ্রেগসনই দইটুকু মারবে।’
‘দেখা যাক কি হয়। তার উপরেই তো সব নির্ভর করছে।’
‘হা ভগবান! মোটেই তা নয়। লোকটি ধরা পড়লে ওদের জন্যই ধরা পড়বে, আর সে যদি পালিয়ে যায় সেও ওদের চেষ্টা সত্বেও যাবে। এ হচ্ছে, আমরা জিতলেও ভেড়ের ভেড়ে, হারলেও ভেড়ের ভেড়ে। ওরা যা করবে তাতেই লোক বাহবা দবে। `Un not trouve tlouj-ours un plus sot quil I’ admire’.
‘ব্যাপার কি?’ আমি চেঁচিয়ে বললাম, কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে হলেও সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনা গেল। গৃহকর্ত্রীর নানারকম বিরক্তিসূচক বাণীও কানে এল।
আমার সঙ্গী গম্ভীরভাবে বলল, ‘এটা হচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনী বেকার স্ট্রীট ডিভিশন।’ তার কথার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত নোংরা একদল বাউন্ডুলে ছেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
‘সোজা হয়ে দাঁড়াও!’ কর্কশ কণ্ঠে হোমস চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দুটি বাচ্চা বদমাইস কুখ্যাত স্ট্যাচুর মত এক লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘ভবিষ্যতে শুধু উইগিন্সকে ভিতরে পাঠাবে খবর দিতে, বাকিরা সব রাস্তায় অপেক্ষা করবে। কোন খবর পেয়েছ উইগিন্স?’
একটা ছেলে জবাব দিল, ‘না স্যার, পাই নি।’
‘পাবে সে আশা আমিও করি নি। কাজ চালিয়ে যাও। এই নাও, তোমাদের পাওনা।’ প্রত্যেককে সে এক শিলিং করে দিল। ‘এখন চলে যাও। এরপর ভাল খবর নিয়ে আসবে।’
সে হাত নাড়তেই তারা সব ইঁদুরের মত লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। পরক্ষণেই রাস্তায়, তাদের কর্কশ গলা শোনা গেল।
হোমস বলল, ‘একজন পুলিশের চাইতে ওদের একটা বাচ্চা ভিখারির কাছ থেকে অনেক বেশী কাজ পাওয়া যায়। সরকারী লোক দেখলেই লোকের ঠোঁট বন্ধ হয়ে যায়। এই বাচ্চাগুলো সব জায়গায় যায়, সব কথা শোনে। ওদের বুদ্ধিও সূঁচের মত তীক্ষ্ম। শুধু প্রয়োজন ওদের গড়ে তোলা।’
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি ব্রিক্সটন কেসে ওদের লাগিয়েছে?’
‘হ্যাঁ। একটা জিনিস আমি সঠিক জানতে চাই। অবশ্য সেটা সময় সাপেক্ষমাত্র। আরে! এখনই কিছু নতুন সংবাদ শুনতে পাব। রাস্তা দিয়ে গ্রেগসন আসছে।তার চোখে-মুখে খুশি উপছে পড়ছে।জানি, এখানেই আসবে। হ্যাঁ, ওই তো দাঁড়িয়েছে। এসে গেছে!’
ঘণ্টটা জোরে বেজে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোয়েন্দা-প্রবর এক লাফে তিনটে করে সিঁড়ি পার হয়ে বসবার ঘরে ঢুকল।
হোমসের অনিচ্ছুক হাতটাকে মুচড়ে ধরে চেঁচিয়ে বলল, ‘বন্ধু. আমাকে অভিন্দন জানান। সবকিছু একেবারে দিনের আলোর মত পরিষ্কার করে ফেলেছি।’
সঙ্গীর মুখের উপর একটা দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল। ‘তুমি কি ঠিক পথে চলেছ বলে মনে কর?’ সে জিজ্ঞাসা করল।
‘ঠিক পথ! লোকটাকে হাতকড়া পরিয়ে ফেলেছি।’
‘তার নাম কি?’
মাননীয়া মহারাণীর নৌ-বিভাগের সহকারী লেফ্টেন্যাপ্ট আর্থার চার্পেন্টিয়ার’, মোটা হাত দুটো ঘসতে ঘসতে বুক ফুলিয়ে গ্রেগসন সদম্ভে কথা গুলি বলল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শালক হোমস একটুখানি হাসল।
বলল, ‘বস। সিগারেট খাও। কি করে এত কান্ড করলে জানতে কৌতুহল হচ্ছে। হুইস্কি আর জল চাই কি?
গোয়েন্দা জবাব দিল, ‘পেলে মন্দ হত না।’ গত দু’একদিন যা পরিশ্রম গেছে, শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। শারীরিক পরিশ্রম যত নয়, তার চাইতে বেশী চাপ পড়েছে মনের উপর। মিঃ শালক হোমস, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কারণ আমরা দুজনেই তো মস্কিষ্কের কারবারী।’
হোমস গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমাকে বড় বেশী সম্মান দেওয়া হচ্ছে, যাহোক এরকম একটা সন্তোষজনক ফল কিভাবে লাভ করলে খুলে বল তো শুনি।’
গোয়েন্দাটি চেয়ারে বসে মনের সুখে সিগার টানছিল। হঠাৎ অতি-আনন্দের উচ্ছ্বাসে উরুতে একটা থাপ্পড়ে মেরে বলে উঠল, ‘মজার ব্যাপার কি জানেন, নিজেকে, খুব চালাক ভাবলে কি হবে ঐ বোকা লেস্ট্রেড একেবারেই ভুলপথ ধরেছে। সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সচিব স্ট্যাঙ্গারসনকে, অথচ অপারাধের সঙ্গে সে কতটুকু জড়িত? যে শিশু এখনও মায়ের পেটে তার চাইতে বেশী নয়’ এতদিনে সে যে তাকে পাকড়াও করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।’
কথাটা ভাবতেই গ্রেগসনের মনে এমন সুড়সুড়ি লাগল যে হাসতে হাসতে তার দম বন্ধ হবার উপক্রম।
‘তোমার সূত্রটি কেমন করে পেলে?’
‘বলছি, বলছি, সবই বলছি। ডঃ ওয়াটসন, আমরা ছাড়া আর কেউ যেন জানতে না পারে। এই মার্কিন অতীত ভদ্রলোকের বৃত্তান্ত জানাটাই হল প্রথম সমস্যা। অন্যরা এ অবস্থায় কি করত, না বিজ্ঞাপনের উত্তর আসা বা কেউ এসে স্বেচ্ছায় কোন খবর দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করত। কিন্তু টোবিয়াস গ্রেগসনের কাজের পদ্ধতি সেরকম নয়। আচ্ছা, মৃত লোকটির পাশের টুপিটার কথা মনে আছে?’