চেয়ারে বসে পড়ে সে চেঁচিয়ে বলে উঠল ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোকদের এ খবর কিছুতেই জানতে দেব না। তাদের আমি এত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছি, যে তারা কিছুতেই এর শেষটা আমাকে শুনতে দেবে না। আমি এখন হাসছি, কারণ আমি জানি অচিরেই আমি তাদের দলেই ভিড়ে যাব।’
‘ব্যাপার কি?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘ওঃ, ইচ্ছার বিরুদ্ধেও গল্পটা বলতে বাধা নেই। কিছুদুর গিয়েই ওই জীবটি খোঁড়াতে আরম্ভ করল, আর পায়ে ঘা হবার সব লক্ষণ দেখাতে শুরু করল। একটু পরেই সে থামল এবং একটা চার চাকার গাড়িকে ডাকল। পরেই সে থামল এবং একটা চার চাকার গাড়িকে ডাকল। ঠিকানাটা শুনবার জন্য আমি এগিয়ে কাছে গেলাম। কিন্তু তার কোন দরকার ছিল না, কারণ সে এত জোরে ঠিকানাটা ঘোষণা করল যে রাস্তার ওপাশ থেকে শোনা যেত। চীৎকার করে বলল, “১৩, ডানকান স্ট্রীট,হাউন্ডসডিচ-এ চালাও।” ভাবলাম তাহলে তো সবই ঠিক। যাহোক, তাকে গাড়ির ভেতরে উঠতে দেখেই আমি পিছন উঠে বসলাম। গোয়েন্দামাত্রকেই একাজে খুব দক্ষ হতে হয়। গাড়ি ছুটে চলল। পূর্বকথিত রাস্তায় পৌঁছে তবে রাস টানল। বাড়ির দরজায় পৌঁছেই আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম এবং হাওয়া খাবার ভঙ্গিতে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। রাশ টানতে গাড়িটা থামল। গাড়োয়ান লাফ দিয়ে নীচে নেমে দরজা খুলে দাঁড়াল। কিন্তু কেউ গাড়ি থেকে নামল না। এগিয়ে গিয়ে দেখি, সে পাগলের মত গাড়ির ভিতরটা খুঁজছে আর নানা রকম অশ্রাব্য গালিগালাজ উচ্চারণ করেছে।গাড়ির আরোহীর কোন পাত্তাই পাওয়া গেল না।বেচারি তার ভাড়াটাও পাবে কিনা সন্দেহ। ১৩ নম্বরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ঐ বাড়ির মালিক কেসুইক নামে এক সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক এবং ও অঞ্চলে কেউ সয়ার বা ডেনিসের নামও কখনও শোনে নি।’
আমি সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, ‘তুমি কি বলতে চাও যে ওই দুর্বল থুথুড়ে বুড়ি তোমায় বা গাড়োয়ানের অজ্ঞাতেই চলন্ত গাড়ি থেকে পালিয়েছে?’
শালক হোমস তীক্ষ্মকণ্ঠে বলে উঠল, ‘বুড়ি জাহান্নামে যাক। আমরাই যে বুড়ি বনে গিয়েছি। সে একটি কর্মঠ যুবক। অতুলনীয় অভিনেতা তো বটেই। তার রুপ-সজ্জা অননুকরণীয়। আমি যে তার পিছু নিয়েছি সেটা বুঝতে পেরেই সে কেটে পড়বার এই পথ বেছে নিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছে, লোকটা একা নয়, তার এমন সব সাকরেদ আছে যারা তার জন্য যেকোন ঝুঁকি নিতে রাজী। আরে ডাক্তার, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমার কথা শোন, শুয়ে পড়গে।’
সত্যি আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছিলাম। তার কথাই শুনলাম। জ্বলন্ত অগ্নি-কুন্ডের পাশে হোমসকে বসিয়ে রেখে আমি চলে গেলাম। অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর বেহলার নীচু করুণ আর্তনাদ আমার কানে এলো। বুঝতে পারলাম, যে বিস্ময়কর রহস্যের সমাধানে সে আত্মনিয়োগ করেছে তখনও সে তার কথাই ভেবে চলেছে।
০৬. টোবিয়াস গ্রেগসনের কেরামতি
পরদিন খবরের কাগজগুলি ছিল ‘ব্রিকসটন রহস্যে’ ভরা। সমস্ত কাগজে র্দীঘ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে অকেনগুলিতে তার উপরে আবার সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। তাতে এমন কিছু তথ্য ছিল যা আমার কাছে নতুন। এই কেস সম্পর্কে খবরের কাগজের অনেক কাটিং ও উদ্ধৃতি এখন আমার ‘স্ক্র্যাপ-বুকে’ রক্ষিত আছে। এখানে তার কিছু কিছু সংক্ষিপ্ত-সার তুলে দেওয়া হলঃ
‘ডেইলি টেলিগ্রাম’-এ মন্তব্য করা হয়েছে যে, অপ-রাধের ইতিহাসে এরুপ বিস্ময়কর বৈশিষ্টাপূর্ণ দুঃখজনক ঘটনা কাদচিৎ দেখা যায়। মৃত ব্যক্তির জার্মান নাম, উদ্দেশ্যের অভাব, দেওয়ালে অশুভ লিখন এই সব দেখে মনে হয় রাজনৈতিক শরণার্থী এবং বিপ্লবীরাই এ ঘটনার নায়ক। আমেরিকায় সমাজতন্ত্রীদের অনেক শাখা আছে। মৃত ব্যক্তি নিশ্চয় তাদের কোন অলিখিত আইন লংঘন করেছিল। এবং শেষ পর্যন্ত তারা তাকে খুঁজে বের করেছে। প্রসঙ্গত ভেমগেরিকট, একোয়া টোকনা, কার্বোনারি, মার্কিওনেস ডি ব্রিনভিলিয়ার্স, ডারুইনের মতবাদ, ম্যালথাস-নীত ও র্যাটক্লিফ রাজপথে খুনের উল্লেখ করে প্রবন্ধের শেষে সরকারকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে এবং ইংলন্ডে বিদেশীদের উপর কড়া নজর রাখবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
‘স্ট্যান্ডার্ড-এ মন্তব্য করা হয়েছে এ ধরনের বেআইনী অত্যাচার সাধারণতঃ উদারনৈতিক সরকারের আমলেই ঘটে থাকে। জনতার মানসিক অস্থিরতা এবং দুর্বলতা থেকেই এদের উদ্ভব। নিহত ব্যক্তি একজন আমেরিকান ভদ্রলোক। কয়েক সপ্তাহ যাবৎ তিনি মহানগরীতে বাস করছিলেন।তিনি কাম্বারওয়েলের অন্তর্গত টকোয়ে টেরেসের ম্যাডাম চাপেন্টিয়ারের বোডিং-হাউসে থাকতেন। এই দেশভ্রমণের সময় তার সঙ্গে ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব মিঃ জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসন। এ মাসের ৪ তারিখ মঙ্গলবার গৃহকর্ত্রীকে বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়ে তারা লিভারপুল এক্সপ্রেস ধরবার উদ্দেশ্যে ইউস্টন স্টেশনে যাত্রা করেন। তারপরেও দুজনকে প্ল্যাটফর্মে দেখা গিয়েছে। সংবাদ অনুসারে, ইউস্টন থেকে অনেক মাইল দুরবর্তী, ব্রিক্সটন রোডের একটি খালি বাড়িতে মিঃ ড্রেবারের মৃতদেহ আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত রহস্যে আবৃত; স্ট্যাঙ্গারসনের গতিবিধি সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায় না। কেমন করে তিনি সেখানে এলেন, বা কেমন করে তার মৃত্যু হল, এসব প্রশ্নই এখনও পর্যন্ত রহস্য আবৃত! স্ট্যাঙ্গারসনের গতিবিধি সম্পর্কেও কিছুই জানা যায় নি। আমরা শুনে সুখী হলাম যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মিঃ লেস্ট্রেড ও মিঃ গ্রেগসন এই কেসটি গ্রহণ করেছেন। আশা করা যায় যে এই দুই সুপরিচিতি অফিসার অতি শীঘ্রই এ ব্যাপারে আলোকপাত করবেন।