আমি ঘরে ঢুকতেই সে বলল, ‘ষড়যন্ত্র ক্রমেই ঘণী-ভূত হচ্ছে। আমেরিকায় যে টেলিগ্রাম করেছিলাম এইমাত্র তার জবাব এল। এ কেসের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত নির্ভুল।’
‘সেটা কি?’ আমি সাগ্রহে প্রুশ্ন করলাম।
সে শুধু বলল, ‘নতুন তার লাগালেই বেহালাটা ভাল বাজবে। পিস্তলটা পকেটে রাখ। লোকটা এলে খুব সহজভাবে কথা বলো। বাকিটা আমি বুঝব। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন ভয় পাইয়ে দিও না।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এখন আটটা বাজে।’
‘হ্যাঁ। সম্ভবত কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে হাজির হবে। আস্তে দরজাটা খুলে দাও। ঠিক আছে। চাবিটা ভিতরে লাগিয়ে রাখ। ধন্যবাদ। এটা একটা অদ্ভুত পুরনো বই—“ডি জুরে ইন্টার জেস্টেস।” কাল একটা স্টলে খুঁজে পেয়েছি। ১৬৪২ সালে লোল্যা-ডসের অন্তর্গত লীজ থেকে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত। চার্লসের মাথা তখনও তাঁর ঘাড়ের উপরে খাড়া ছিল। সেই সময়েই এই বাদামী মলাটের ছোট বইটাকে বাতিল করা হয়েছিল।’
‘‘মুদ্রাকর কে?’
‘কে এক ফিলিস্পি ডি ক্রয়। প্রথম পাতায় খুব অস্পষ্ট কালিতে লেখা“Ex Libris Guliemi Whyte” জানি না কে এই উ্ইলিয়াম হোয়াইট। হয়তো সপ্তদশ শতাব্দীর কোন ধুরন্ধর আইনজীবী। তার লেখায় একটা আইনগত প্যাঁচ আছে। মনে হচ্ছে, লোকটি আসছে।’
কথার সঙ্গে সঙ্গেই ঘণ্টাটা জোরে বেজে উঠল আস্তে উঠে হোমস চেয়ারটাকে দরজার দিকে ঠেলে দিল। শুনতে পেলাম, পরিচাব্রিকা হলের ভিতর হলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হুট করে তালা খুলে দরজা খুলে দিল।
‘ডঃ ওয়াটসন কি এখানে থাকেন?’ একটি স্পষ্ট কর্কশ কণ্ঠের প্রশ্ন কানে এল। পরিচারিকার জবাব শুনতে পেলাম না। কিন্তু দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং একজন কেউ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। পায়ের শব্দ অনিশ্চিত এবং এলোমেলো। কান পেতে শুনে আমার সঙ্গীর চোখেমুখে একটা বিস্ময়ের আভা খেলে গেল। পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে প্যাসেজ পার হয়ে এল। আস্তে দরজায় একটা টোকা পড়ল।
‘ভিতরে আসুন,’ আমি জোরে বললাম।
আমার ডাকে প্রত্যাশিত একটি দুর্ধর্ষ লোকের বদলে একটি কুঞ্চিতমুখ বৃদ্ধা ঘরে ঢুকল। ঘরের আকস্মিক কড়া আলোয় তার চোখ যেন ঝলসে গেল।
অভিবাদন জানিয়ে সে আমাদের দিকে মিটমিট করে তাকাতে লাগল। হাতের আঙুলগুলো বুঝি বা পকেটের মধ্যেই কাঁপছে। সঙ্গীর দিকে তাকালাম। তার মুখে নিরাশার ছায়া।
সান্ধ্য দৈনিকখানা বের করে বুড়ি আমাদের বিজ্ঞাপনটা দেখাল। তারপর আর একবার মাথা নুইয়ে বলল, ‘মশায়রা, এইটে দেখেই এখানে এসেছি। ব্রিকসটন রোডে একটা সোনার বিয়ের আংটি। এই বারো মাস হল তার বিয়ে হয়েছে। সোয়ামি রাজকীয় নৌবহরের সরকার। ফিরে এসে সে যখন দেখবে বৌ-এর হাতে আংটি নেই, তখন কি যে হবে আমি ভাবতেই পারছি না। ভাল সময়েই তার টানাটানি চলে, যখন মদে চুর হয় তখন তো কথাই নেই। কাল রাতে সে সার্কাস দেখতে—’
‘এটা তার আংটি কি?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
বুড়ি চেঁচিয়ে উঠল, ‘যীশুকে ধন্যবাদ! আজ রাতে শাবী স্বস্তি পাবে। ঐ আংটিটাই।’
একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে বললাম, ‘তোমার ঠিকানা কি?’
’১৩-ডানকান স্ট্রীট, হাউন্ডসডিচ। এখান থেকে অনেকটা পথ।’
সঙ্গে সঙ্গে শালক হোমস বলে উঠল, ‘কেন সার্কাস অন্য হাউন্ডসডিচের মধ্যে তো ব্রিকসটন রোড পড়ে না।’
বাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়ে লাল চোখ মেলে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। বলল, ‘ভদ্রলোক আমার ঠিকানা জানতে চেয়েছেন। স্যালী থাকে ০,. মেফিল্ড প্লেস, শেষহাম-এ।’
‘আর তোমার নাম?’
‘আমার নাম সয়ার—মেয়ের নাম ডেনিস, কারণ টম ডেনিস তাকে বিয়ে করেছে। যতদিন সমুদ্রে থাকে ছোকরা খুব চালাক-চতুর। কোম্পানির আর কোন সরকারের ওর মত সুনাম নেই। কিন্তু মাটিতে পা দিলেই মেয়েমানুষ আর মদের দোকানে মিলে—’
সঙ্গীর ইঙ্গিতে আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘মিসেস সয়ার, এই তোমার আংটি। নিশ্চয় এটা তোমার মেয়ের। প্রকৃত মালিককে এটা ফিরিয়ে দিতে পারায় আমি খুশি।’
অনেক আশীর্বাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বুড়ি আংটিটা পকেটে ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শালক হোমস লাফ দিয়ে উঠে তার ঘরে ছুটে চলে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অলেস্টার আর গলাবন্ধ পরে ফিরে এসে খুব তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি ওর পিছু নেব। ও নিশ্চয়ই দলের লোক। ওর সঙ্গে গেলেই তার হদিস মিলবে। আমার জন্য জেগে থেক।’ নীচে হলঘরের দরজা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গেই নীচে নেমে গেল। জানালা দিয়ে আমি দেখতে পেলাম, রাস্তার ওপার দিয়ে বুড়ি দুর্বল পায়ে এগিয়ে চলেছে, আর তার অনুসরণকারী কিছুটা দুরে থেকে তার পিছু নিয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, হয় তার সমস্ত সিদ্ধান্তটাই ভুল আর না হয় তো এবার সে রহস্যের একেবারে মাঝখানে গিয়ে পড়বে। আমাকে জেগে থাকতে বলার কোন দরকারই ছিল না, কারণ তার এই অভিযানের ফলাফল না জানা পর্যন্ত ঘুমানো আমার পক্ষে অসম্ভব।
প্রায় ন’টা নাগাদ সে বেরিয়ে গেল। কখন ফিরবে জানি না। তাই বোকার মত বসে পাইপ টানতে টানতে হেনরি মার্জারের “ভাই ডি বোহেম” এর পাতা ওল্টাতে লাগলাম। দশটা বাজল। পরিচারিকার পায়ের শব্দ তার শোবার ঘরের দিকে মিলিয়ে গেল। এগারোটা, এবার গৃহকত্রীর পায়ের শব্দও ঐ একই লক্ষ্যপথে আমার দরজার পাশ দিয়ে চলে গেল। প্রায় বারোটা নাগাদ তার সিটকিনির চাবির শব্দ শুনতে পেলাম। ঘরে ঢোকামাত্রই তার মুখ দেখে বুঝলাম, কোন কাজ হয় নি। ফূর্তি ও বিরক্তি পাঞ্জা লড়তে লড়তে একসময়ে ফূর্তিরই জয় হল,–সে হো হো করে হেসে উঠল।