সঙ্গী বাধা দিল, ‘তুমি থেমে গেলে এবং আবার বাগানের গেটের কাছে ফিরে গেলে। এরকমটা কেন করলে?’
রাঞ্চ একটা প্রকান্ড লাফ দিয়ে অবাক বিস্ময়ে শালর্ক হোমসের দিকে হী করে তাকিয়ে বলল, ‘আর, ঠিক তাই স্যার। ভগবান জানেন সেকথা আপনি জানলেন কেমন করে? বুঝতেই তোর পারছেন, যখন আমি দরজার কাছে পৌঁছলাম তখন চারিদিকটা এমন নির্জন আর থমথমে যে মনে হল এ অবস্থায় একজন সঙ্গে থাকলে মন্দ হয় না। যদিও কবরের এপারে কোন কিছুকেই আমি ভয় পাই না, তবু কেন জানি মনে হল, ড্রেন পরীক্ষা করতে গিয়ে টাইফয়েড হয়ে যে মারা গেছে এটা হয় তো তারই কাজ। এই ভাবনাই আমাকে ঘুরিয়ে দিল। মার্চারের লণ্ঠনাটা চোখে পড়ে কি না দেখবার জন্য আমি গেটের কাছে ফিরে গেলাম। কিন্তু তাকে বা অন্য কাউকেই দেখতে পেলাম না।
‘পথে কেউ ছিল না?’
‘কোন জীবন্ত প্রাণী নয় স্যার। একটা কুকুর পর্যন্ত না। তখন সাহস করে ফিরে গেলাম এবং ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললাম। ভিতরে চুপচাপ। ঘরের মধ্যে যেখানে আলোটা জ্বলছিল সেখানে গেলাম। ম্যান্টেল-পিসের উপর মোমবাতিটা—একটা লাল মোমবাতি জ্বলছিল আর তারই আলোয় দেখলাম—’
জন রাঞ্চ লাফিয়ে উঠল। তার মুখে ভয়, তার চোখে সন্দেহ। চেঁচিয়ে বলল, ‘এসব দেখবার জন্য আপনি কোথায় লুকিয়ে ছিলেন? আমি তো দেখেছি, আপনি এমন অনেক কিছুই জানেন যা আপনার জানবার কথা নয়।’
হোমস হেসে উঠল। তার কাডখানা কনেস্টবলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খুনের দায়ে আমাকেই যেন গ্রেপ্তার করে বসো না। আমিও একটি শিকারী, নেকড়ে নই। মিঃ গ্রেগসন বা মিঃ লেস্ট্রেডের কাছেই সব জানতে পারবে। এখন বলে যাও। তারপর কি করলে?’
রাঞ্চ আবার আসনে বসল। তার চোখে তখনও বিস্ময়ের ঘোর। ‘গেটের কাছে গিয়ে আমার বাঁশিটা বাজালাম। তাই শুনে মার্চার এবং আরও দুজন ঘটনাস্থলে হাজির হল।’
‘তখন কি রাস্তা খালি ছিল?’
‘তা—ছিল। কাজেই লোক বলতে কেউ ছিল না।’
‘তুমি কি বলতে চাও?’
কনেস্টবলের মুখে মুচকি হাসি খেলে গেল। বলল, ‘জীবনে অনেক মাতাল আমি দেখেছি, কিন্তু ও ব্যাটার মত পাড় মাতাল কখনও দেখি নি; আমি যখন বেরিয়ে আসি, সে তখন রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর কলম্বাইনের “খোলা নিশান” বা ঐ জাতীয় কোন গান গলা ফাটিয়ে গাইছিল। ব্যাটা পায়ের উপর দাঁড়াতেই পারছিল না, তার সাহায্য করবে কি।’
‘লোকটা কেমন?’ শার্লক হোমস প্রশ্ন করল।
একথায় জন রাঞ্চ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কেমন আবার? বেহদ্দ মাতাল হলে যেমন হয়। তখন যদি আমরা ওরকম ব্যস্ত না থাকতাম তাহলে তো শ্রীমানকে থানায় নিয়ে যেতাম।’
হোমস অধীরভাবে বলে উঠল, ‘তার মুখ—তার পোশাক—সেসব কি লক্ষ্য কর নি?’
‘তা মনে হয় করেছিলাম। আমি আর মার্চারই তো অতি কষ্টে তাকে সোজা করে দাঁড় করিয়েছিলাম। লোকটা বেশ লম্বা, লাল মুখ, নীচের দিকটা জড়ানো—’
হোমস চেঁচিয়ে বলল, ‘ওতেই হবে। তারপর কি হল?’
পুলিশটি ক্ষুদ্ধ গলায় বলল, ‘তার দিকে নজর দেওয়ার চাইতে অনেক বড় কাজ আমাদের ছিল। আমি বাজী ধরে বলতে পারি, সে ঠিক বাড়ি পৌঁছেছিল।’
‘তার পরনে কি ছিল?’
‘একটা বাদামী ওভারকোট।’
‘হাতে একটা চাবুক ছিল?’
‘চাবুক—না।’
‘নিশ্চয়ই রেখে এসেছিল।’ আমার সঙ্গী নিজের মনেই বলল।
‘তারপরই কোন গাড়ি দেখ নি? বা গাড়ির শব্দ শোন নি?’
‘না।’
‘এই নাও তোমার আধ-গিনি।’ আমার সঙ্গী উঠে দাঁড়িয়ে টুপিটা হাতে নিল। ‘আমার ভয় হচ্ছে রাঞ্চ, পুলিশ-লাইনে তুমি কোনদিন উন্নতি করতে পারবে না। দেখ, তোমার মাথাটা শুধু শোভাই নয়, ওটাকে কাজে লাগাতেও হয়। কাল রাতেই তুমি সার্জেন্টের পদ অর্জন করতে পারতে। কাল যে লোকটিকে তুমি হাত ধরে তুলে-ছিলে সেই এই রহস্যের গুরু আর তাকেই আমরা খুঁজছি। এখন এ নিয়ে তর্ক করে কোন লাভ নেই। আমি বলছি, এটাই ঠিক। চলহে ডাক্তার।’
আমার গাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। কনেস্ট-বলটির মনে তখনও অবিশ্বাস থাকলেও সে বেশ অস্বস্থিত বোধ করতে লাগল।
বাসার দিকে যেতে যেতে হোমস তিক্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘একেবারে বেহদ্দ বোকা! ভেবে দেখ, এমন একটা অতুলনীয় সৌভাগ্য ওর হাতের কাছে এসেছিল, অথচ ও সেটাকে কাজে লাগাতে পারল না।’
‘আমি কিন্তু এখন সেই অন্ধকারেই আছি। এ কথা ঠিক যে, এই রহস্যের দ্বিতীয় পক্ষ সম্পর্কে তোমার ধারণার সঙ্গে এই লোকটির বিবরণ মিলে যাচ্ছে। কিন্তু ঐ বাড়ি থেকে চলে গিয়েও সে আবার ফিরে আসবে কেন? অপরাধীরাও তো এরকম করে না।’
‘ঐ আংটি, বাবা ঐ আংটি। ঐ আংটির জন্যই সে ফিরে এসেছিল। তাকে ধরবার আর কোন পথ যদি না পাই, ওই আংটিটাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। ডাক্তার, আমি তাকে পাবই, বলতে পার পেয়ে গেছি। আর এসবের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি না থাকলে আমি হয় তো সেখানেই যেতামই না। আমর এমন একটা অদ্ভুত-পূর্ব সূক্ষ্ম সমীক্ষা আমার হাতছাড়া হয়ে যেতঃ রক্ত-না কেন? জীবনের বর্ণহীন বস্ত্রের ভিতর দিয়ে বোনা হয়েছে হত্যার একগাছি রক্তববর্ণ সুতো। আমাদের কাজ তাকে আবিষ্কার করা, পৃথক করা, তার প্রতিটি ইঞ্চিকে প্রকাশিত করা। কিন্তু এবার লাঞ্চে যেতে হবে আর সেখান থেকে নর্মান নেরুদার উদ্দেশ্যে। তার প্রতিটি কাজ অনবদ্য। কিরকম আশ্চর্জনকভাবে সে “চপিন”-এর সুর বাজায়ঃ ট্রা—লা—লা—লিরা—লিরা—লে—’
গাড়ির মধ্যে হেলান দিয়ে এই সৌখিন শিকারী কুকুর চাতক পাখির মত গান গেয়ে উঠল। আর আমি মানব মনের বিপুল বৈচিত্র্যের চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইলাম।
০৫. বিজ্ঞাপন ও আগন্তুক
আমার দুর্বল স্বাস্থ্যের পক্ষে সকালবেলাটা তাই খুবই শ্রমটা একটু বেশীই হয়েছিল। বিকেলবেলাটা তাই খুবই ক্লান্ত লাগছিল। হোমস কনসার্টে চলে গেল, আমি সোফায় শুয়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সকালবেলাকার ঘটনাবলীতে আমার মন খুবই সেখানে ঢুঁ মেরে চলেছে। যতবার চোখ বুজি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিহত লোকটির বিকৃত বেবুনের মত মুখ। ঐ মুখটা আমার মনের উপর এমন একটা অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছিল যার ফলে ঐ মুখের মালিককে যে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু অনুভব করা আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। মানুষের মুখে যদি জঘন্যতম কোন পাপের প্রকাশ হয়ে থাকে তবে সে মুখ ক্লিভল্যান্ডের এনক জে, ড্রেবারের। তথাপি আমি স্বীকার করি, ন্যায় বিচার অবশ্য হওয়া উচিত; মৃতের দুশ্চরিত্রতার জন্য আইনের চোখে অপরাধীর কোন ক্ষমা থাকতে পারে না।