গ্রেগসন এবং লেস্ট্রেড তাদের সৌখিন সহকর্মীর এই সব পায়তাড়া বেশ কৌতুহল ও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লক্ষ্য করছিল। শার্লক হোমসের তুচ্ছতম কাজও যে একটা সুনির্দিষ্ট বাস্তব লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত এ সত্য আমি বুঝতে আরম্ভ করলেও তারা কিন্তু এখনও বুঝতে অপারগ।
দুজনে একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?’
আমার বন্ধু, জবাব দিল, ‘আমি তোমাদের সাহায্য করছি একথা মনে হলেই যে এ কেসের কৃতিত্ব থেকে তোমাদের বঞ্চিত করা হবে। তোমরা এত ভাল কাজ করছ যে জন্যর হস্তক্ষেপ খুবই দুঃখের কারণ হতে পারে।’ মজার স্বরে প্রচুর ঠাট্রা মিশিয়ে সে বলতে লাগল, ভেতরে তদন্তের কাজ কিভাবে চালাচ্ছ যদি আমাকে বল, তোমাদের কোনরকম সাহায্য করতে পারলে আমি খুমি হব। ইতিমধ্যে যে কনেস্টবল মৃতদেহটি আবিষ্কার করেছিল, তার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। তার নাম, ঠিকানাটা আমাকে দিতে পার?’
লেস্ট্রেড নোটবুক দেখে বলল, ‘জন রাঞ্চ। এখ তার ছুটি, কেনিংটন পার্ক গেটের ৪৬, অডলি কোটে তাকে পাবেন।’
হোমস ঠিকানা লিখে নিল।
তারপর বলল, ‘চল ডাক্তার। তাকে খুঁজে বের করতে হবে।’ গোয়েন্দা-যুগলের দিকে ফিরে বলল, ‘খুন হয়েছে। খুনি একজন পুরুষ মানুষ। উচ্চতায় ছ’ফুটের বেশী, বয়সে যুবক, উচ্চতার তুলনায় পা দুটো ছোট, পায়ে চৌকো-মাথা বুট, ঠোঁটে ত্রিচিনোপলি সিগার। একটা চার চস্কার গাড়িতে করে শিকারকে নিয়ে সে এখানে এসেছিল। গাড়িটা ছিল এক-ঘোড়ায় টানা, আর ঘোড়াটার তিন পায়ে ছিল পুরনো নাল এবং সামনের এক পায়ে ছিল নতুন নাল লাগানো। খুব সম্ভব খুনীর মুখের রং লাল, আর ডান হাতের আঙুলের নখগুলো বেশ লম্বা। অল্প গোটাকয় লক্ষণ উল্লেখ করলাম। তবে এগুলো তোমাদের কাজে লাগতে পারে।’
লেস্ট্রেড এবং গ্রেগসন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের হাসি হাসল।
লেস্ট্রেড বলল, ‘লোকটি যদি খুনি হয়ে থাকে, তাহলে কিভাবে খুব করা হয়েছে?’
‘বিষ।’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে শালক হোমস যাবার জন্য পা বাড়াল। দরজার কাছে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আর একটা কথা লেস্ট্রেড। ‘RACHE’ হচ্ছে “প্রতিহিংসা’র জামার্ন প্রতিশব্দ; কাজেই মিস রাসেলকে খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট করো না।’
শব্দের তীরটি ছুঁড়ে দিয়েই সে চলে গেল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হী করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
০৪. জন রাঞ্জের জবানবন্দী
৩নং লরিস্টন গর্ডেন্স থেকে যকন বেরলাম তখন বেলা একটা। শালক হোমস নিকটবর্তী টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে একটা লম্বা তার পাঠাল। তারপর একটা গাড়ি ডেকে গাড়োয়ানকে লেস্ট্রেডের দেওয়া ঠিকানায় যাবার নিদেশ দিল।
যেতে যেতে সে বলল, ‘চোখে-দেখা প্রমাণের মত কিছু হয় না। আসলে এ কেস সম্পর্কে আমার মন সব ঠিক করে ফেলেছে। তথাপি যা কিছু জানবার আছে সেসব জানাই ভাল।ৎ
আমি বললাম, ‘তুমি আমাকে বিস্মিত করেছ হোমস। যেরকম নিশ্চয়তার সঙ্গে খুটিনাটি কথা তুমি জানালে, নিশ্চয় আসলে ততটা নিশ্চিত তুমি নও।’
উত্তরে সে বলল, ‘ভুলের কোনরকম সুযোগই নেই। ওখানে পৌঁছে প্রথমেই আমি লক্ষ্য করলাম, পথের উপর একটা গাড়ির চাকার দুটো দাগ পড়েছে। এখন, গত রাতের আগে গত এক সপ্তাহ এখানে কোন বৃষ্টি হয় নি। কাজেই যে চাকাগুলির দাগ এত গভীরভাবে মাটিতে বসে গেছে সেগুলি নিশ্চয় গত রাত্রেই সেখানে এসেছিল। ঘোড়ার ক্ষুরের যে দাগ সেখানে রয়েছে তার একটা অন্য তিনটের তুলনায় বেশী গভীর। তা থেকেই বোঝা যায় ক্ষুরের একটা নাল নতুন। যেহেতু বৃষ্টি আরম্ভ হবার পরেও গাড়িটা সেখানে ছিল এবং কাল সকালে কোন সময়ই সেটাকে দেখা যায় নি—একথা গ্রেগসনই বলেছে—সুতরাং অনুমান করা চলে যে রাত্রে ওটা সেখানেই ছিল এবং ওই গাড়িতে করেই দুই ব্যক্তি ও বাড়িতে এসেছিল!’
আমি বললাম, ‘এটা তো বেশ সোজা। কিন্তু অপর লোকটির উচ্চতা?’
‘কেন? প্রতি দশজনের ন’জনের ক্ষেত্রেই পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য দেখেই তার উচ্চতা বলে দেওয়া যায়। ‘হিসাবটা খুবই সোজা। তার বিবরণ দিয়ে তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। বাইরের মাটিতে এবং ঘরের ধুলোর মধ্যে এই লোকটির পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য আমি দেখেছি। তারপর একটা বিশেষ উপায়ে হিসাবটা আমি পরীক্ষা করেও নিয়েছি। কোন লোক যখন দেওয়ালে কিছু লেখে, সাধারণত সে তার চোখের সমান উচ্চতায়ই লেখে। ঐ লেখাটা আছে মেঝে থেকে ছ’ফুটের সামান্য উঁচুতে। বাকিটা তো ছেলেখেলা।’
‘আর তার বয়স?’ আমি প্রশ্ন করলাম। একটাোক যদি অনায়াসে প্রতি পদক্ষেপে সাড়ে চার ফুট পার হতে পারে তাহলে সে নিশ্চয়ই অথর্ব বৃদ্ধ নয়। বাগানের পথে একটা খানা পথ আছে। সেটাও সে পার হয়েছে নিশ্চয়। পেটেন্ট লেদার জুতোর ছাপ রয়েছে চার দিকে। তার চৌকোণা ডগার চিহ্ন ও স্পষ্ট। এর মধ্যে তো রহস্যের কিছু নেই। আমার সেই প্রবন্ধটাতে পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের যেসব নীতির উল্লেখ আমি করেছি, তারিই কিছু কিছু বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেছি মাত্র, আর কিছু কি বুঝবার আছে?’
‘আঙুলের নখ আর ত্রিচিনোপোলি,’ আমি মনে করিয়ে দিলাম।
‘একটা মানুষের তর্জনীকে রক্তে ডুবিয়ে দেওয়ালের উপর শব্দটা লেখা হয়েছে। আমার কাঁচের সাহায্যে দেখেছি। লেখার দরুন দেওয়ালের প্লাসারে কিছুটা আচঁড় লেগেছে। ছাইটা দেখতে কালো এবং পাতলা আঁশযুক্ত। এরকম ছাই একমাত্র ত্রিচিনোপোলি সিগারে হয়। সিগারের ছাই নিয়ে আমি অনেক পড়াশুনা করেছি, ও বিষয়ে একখানা ছোট বইও লিখেছি। আমি গর্ব করে বলছি, যেকোন পরিচিত ব্যান্ডের সিগার বা তামাকের ছাইয়ের পার্থক্য আমি একবার দেখলেই বলে দিতে পারি। এই সব ছোটখাট ব্যাপার নিয়েই একজন দক্ষ গোয়েন্দা আর লেস্ট্রেড-গ্রেগসনের মধ্যে এত তফাৎ।’