‘কোন ঠিকানায়?’
‘আমেরিকান এক্সচেঞ্জ, স্ট্যান্ড না চাওয়া পর্যন্ত থাকবে। দু’খানিই এসেছে “গুইওন স্টীমশিপ কোম্পানি” থেকে। তাদের জাহাজ যে লিভারপুল থেকে ছাড়া হয়েছে তারও উল্লেখ আছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এই ভাগ্য-হীন লোকটির শীঘ্রই নউ ইয়র্কে ফিরবার কথা।’
‘এই স্ট্যাঙ্গারসন সম্পর্কে কোন খোঁজ-খবর করেছ?’
গ্রেগসন বলল, ‘সঙ্গে সঙ্গেই করেছি স্যার। সবগুলো খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। একজন লোককে পাঠিয়েছি আমেরিকান এক্সচেঞ্জ-এ। সে এখনও ফেরে নি।’
‘ক্লিভল্যান্ডে কাউকে পাঠিয়েছ?’
‘সকালেই টেলিগ্রাম করে দিয়েছি।’
‘তাতে কি লিখছে?’
‘অবস্থার বিররণ দিয়ে বলেছি, আমাদের পক্ষে সহায়ক কোন সংবাদ জানালে খুশি হব।’
‘তোমারা চুড়ান্ত মনে কর এরকম কোন খবর জানতে চেয়েছ কি?’
‘স্টারঙ্গারসনের খবর জানতে চাওয়া হয়েছে।’
‘আর কিছু নয়? এমন কোন ঘটনা কি নেই যার উপর কেসটা ঝুলে আছে? আর একবার টেলিগ্রাম করতে পার না?’
আহত গলায় গ্রেগসন বলল, ‘আমার যা বলবার সবই বলেছি।’
শার্লক হোমস মুখ টিপে হাসল। তারপর কি যেন বলতে যাবে এমন সময় সামনের ঘর থেকে খুব খুশি-খুশি ভাবে হাত দুটো ঘসতে ঘসতে লেস্ট্রেড হল-ঘরে ঢুকল।
‘মিঃ গ্রেগসন,’ সে বলল, ‘এই মাত্র একটা খুব বড় রকমের আবিষ্কার করে ফেলেছি। দেওয়ালটাককে ভাল করে পরীক্ষা না করলে সেটা ধরাই পড়ত না।’
কথা বলবার সময় এই ছোটখাটো লোকটির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল। সমকর্মীর উপর একহাত নেবার আনন্দ যেন তার চোখ-মুখে ফুটে উঠেছে।
‘আমার সঙ্গে এস’ বলে সে দ্রুত সেই ঘর থেকে ফিরে গেল। ভয়ংকর লোকটির সরিয়ে নেওয়ায় সে ঘরের আবহাওয়া তখন অনেকটা হাল্কা হয়েছে। ‘এবার, ওইখানে দাঁড়াও!’
‘জুতার তলায় একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে সে দেওয়ালের দিকে তুরে ধরল।
‘ঐটে দেখ!’ বিজয়গর্বে বলল।
আগেই বলেছি, দেওয়ালের অনেক জায়গায়ই কাগজ খুলে খুলে পড়েছি। ঘরের ঐ বিশেষ কোণটায় অনেক বড় একখন্ড কাগজ খুলে পড়ায় হলদে প্ল্যাস্টার বেরিয়ে পড়েছে। সেই চৌ-কোণা প্লাস্টারের উপর রক্ত-লাল অক্ষরে একটিমাত্র শব্দ লেখা আছে—
RA CHE (রাসে)
একজন প্রদর্শক যেভাবে তার খেলা দেখায় সেইরকম ভঙ্গীতে গোয়েন্দাপ্রবর চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এটার বিষয়ে তুমি কি বলছ? ঘরের একেবারে অন্ধকার কোণে রয়েছে বলে এটা কারও চোখে পড়ে নি, এদিকটা দেখার কথাও কেউ ভাবি নি। খুনি নিজের রক্ত দিয়ে এটা লিখেছে। দেখ, দেওয়াল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা-যে আত্মহত্যা নয় সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। লেখবার জন্য ঐ কোণটা বেছে নেওয়া হল কেন? সেটাও বলছি। ম্যান্টেলপিসের বেছে নেওয়া হল কেন? সেটাও বলছি। ম্যান্টেলপিসের উপর ঐ মোমবাতিটা দেখ। ঘটনার সময় ওটা জ্বালান ছিল, আর ওটা জ্বললে ঘরের ঐ কোণটা সবচাইতে অন্ধকার না হয়ে সবচাইতে উজ্জ্বল হয়।’
অসন্তোষের ভাব নিয়ে গ্রেগসন প্রশ্ন করল, ‘বেশ তো, তুমি ওটা দেখেছ, কিন্তু তাতে কি বোঝা গেল?’
‘কি বোঝা গেল? বোঝা গেল যে লেখক একটি মেয়ের নাম “রাসেল” লিখতে চেয়েছিল, কিন্তু লেখাটা শেষ করবার আগেই কোন বিঘ্ন ঘটে। আমার কথাটা বোঝ, এই কেসের কিনারা যখন হবে তখন দেখতে পারে রাসেল নামের একটি মেয়ে এর সঙ্গে জড়িত আছে। মিঃ শার্লক হোমস, আপনি হাসতে পারেন। আপনি খুব তুখোড় ও চতুর হতে পারেন, কিন্তু সব কথার সেরা কথা হল—পুরেনো চাল ভাতে বাড়ে।’
হো-হো করে হেসে উঠে আমার সঙ্গী এই ছোটখাট লোকটির মেজাজ সত্যি খি’চড়ে দিয়েছিল। তাই সে বলল, ‘সত্যি, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি প্রথম এটা দেখেছ, এ কৃতিত্ব অবশ্যই তোমার প্রাপ্য। গত রাত্রের রহস্যের অপর অংশীদারই যে এটা লিখেছে সে বিষয়েও তোমার সঙ্গে আমি একমত। এ ঘরটা পরীক্ষা করে দেখবার সময় আমি এখনও পাই নি। তোমার অনুমতি নিয়ে সে কাজটা এবার করতে চাই।’
বলতে বলতেই সে পকেট থেকে একটা মাপের ফিতে ও একটা বড় ম্যাগ্মিফায়িং গ্লাস বের করে ফেলল। তারপর এই দুটি হাতিয়ার নিয়ে নিঃশব্দে ঘরময় দাপাদাপি শুরু করে দিল। কখনও থামছে, কখনও হাঁটুগেড়ে বসছে, একবার তো টানটান হয়ে উপুড় হয়ে শুয়েই পড়ল। নিজের কাজে তখন সে এতই মগ্ন যে আমাদের উপস্থিতি পর্যন্ত ভুলে গেল। সারাক্ষণ নিজের সঙ্গেই কথা বলে চলেছে—কখনও উল্লাস, কখনও আর্তনাদ; এই হয় তো শিস দিচ্ছে, আবার পরক্ষণেই উৎসাহে ও আশায় চীৎকার করে উঠছে। তাকে দেখে তখন আমার এক সুশিক্ষিত ভাল জাতের শিকারী কুকুরের কথা মনে হচ্ছিল; শিকারের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত সেও তো এমনই তীব্র কৌতূহলে ঝোপ-ঝাড়ের ভিতরে এমনিভাবে কখনও এগোয়, কখনও পেছোয়। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে সে তার কাজ চালিয়ে গেল। আমার চোখে সম্পূর্ণ অদৃশ্য দাগগুলির দুরত্ব বেশ যত্ন নিয়ে সঠিকভাবে মাপল। কখনও আবার কেন যে ফিতেটাকে দেওয়ালের গায়েও ব্যবহার করল সেটা তো আমার কাছে দুর্বোধ্য। এক জায়গায় মেঝে থেকে এক –মুঠো ধুলো খুব যত্ন করে তুলে নিয়ে কামে ভরে রাখল। শেষকালে দেওয়ালের লেখার উপর কাঁচটা ধরে প্রতিটি অক্ষরকে সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করে দেখল। কাজ শেষ করে খুশি মনে ফিতে আর কাঁচটা পকেটে রেখে দিল।
হেসে বলল, ‘লোকে বলে, বেদনা সহ্য করবার অসীম ক্ষমতাই হল প্রতিভা। এটা খুব বাজে সংজ্ঞা কিন্তু গোয়েন্দাদের কাজে এটা সত্যি খাটে।’