কাঠের পাটাতন-করা ধুলোভরা একটা প্যাসেজ রান্না-ঘর ও অফিসের দিকে চলে গেছে। বাঁয়ে ও ডাইনে দুটো দরজা। দেখেই বোঝা যায় একটা দরজা বেশ কয়েক সপ্তাহ যাবৎ বন্ধই আছে। অপর দরজাটি খাবার ঘরের। রহস্যময় ঘটনাটি ঘটেছে সেই ঘরেই। হোমস ভিতরে পা বাড়াল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। মৃত্যুর উপ-স্থিতির অনুভূতিতে আমার মন আচ্ছন্ন।
একটা বড় চৌকোণা ঘর। আসবাবপত্র কিছুই নেই বলে আরও বড় দেখাচ্ছে। দেওয়ালে ঝকমকে সস্তা কাগজ মোড়। ছ্যাতলা পড়ে জায়গায় জায়গায় দাগ ধরেছে। কোথাও বা অনেকটা কাগজ খুলে গিয়ে ঝুলে পড়েছে।ফলে নীচেকার হলদে প্লাসটার বেরিয়ে পড়েছে। দরজাটার উল্টো দিকে একটা সৌখিন অগ্নিকুন্ড, তার উপরে নকল শ্বেত পাথরের ম্যান্টেলপিস। তার এককোণে একটা লাল মোমবাতির শেষটুকু বসানো। ঘরের একমাত্র জানালায় এত ধুলো-ময়লা জমেছে যে ঘরের আবছা আলোয় সব কিছুতেই একটা হলদে আভা পড়েছে। সারা ঘরে ধুলোর আস্তরণ পড়ায় সেই হলুদ আভায় আরও বেশী করে চোখে লাগছে।
এ সবই আমি পরে লক্ষ্য করেছি। তখনকার মত আমার সব মনোযোগ পড়ল একটিমাত্র ভয়াবহ নিশ্চল মনু্ষ্যদেহের প্রতি। দেহটি মেঝের পড়ে রয়েছে। দৃষ্টি-হীন শূন্য চোখ যেন তাকিয়ে আছে বিবর্ণ শিলিংএর দিকে। লোকটির বয়স হবে বছর তেতাল্লিশ, মাঝারি গড়ন, চওড়া কাধ, কালো কোঁকড়ানো চুল, ছোট ঘন দাঁড়ি। পরনে মোটা কাপড়ের কোটও ওয়েস্টকোট। হালকা রঙের ট্রাউজার, চকচকে কলার ও কফ। ব্রাশ-করা তকতকে একটা টপ হ্যাট তার পাশেই মেঝের উপর পড়ে আছে। দুই হাত মুষ্টিবন্ধ। দুই বাহু, ছড়ানো, দেহের নিষ্মাংশ একসঙ্গে জড়ানো। দেখে মনে হয় মৃত্যুর বিরুদ্ধে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তার শক্ত মুখে বিভীষিকার ছায়া। আমার মনে হল সে মুখে এত তীব্র ঘৃণা ফুটে উঠেছে যা আমি কখনও মানুষের মুখে দেখি নি। দেহের এই উৎকট ভয়ংকর বিকৃতির সঙ্গে নীচু কপাল, থ্যাবড়া নাক ও পুরু-ঠোঁট যুক্ত হয়ে একটি বানর-সুলভ আকৃতি গড়ে উঠেছে। তার দেহের দুমড়ানো অস্বাভিক ভঙ্গীর জন্য সেটা যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। নানা ধরনের মৃত্যু আমি দেখেছি,কিন্তু লন্ডনের উপ-কণ্ঠবর্তী একটি প্রধান রাজপথের এই অন্ধকার ভয়ংকর ঘরে তার যে ভয়াবহ রূপ দেখলাম তার আর কখনো দেখি নি।
ক্ষীণকায় ভোঁদড়-সূলভ আকৃতির লেস্ট্রেড দরজায়ই দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দুজনকেই সে অভ্যর্থনা করল।
বলল ‘এই কেস নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে যাবে স্যার। এমনটি আমি আর দেখি নি। আর আমি কিন্তু ছেলে-মানুষ নই।’
গ্রেগসন বলল, ‘কোন সূত্র পাওয়া গেল?’
লেস্ট্রেড জবাব দিল, ‘কিচ্ছু না।’
শালক হোমস মৃতদেহের কাছে এগিয়ে হাঁট গেড়ে বসে ভাল করে পরীক্ষা করল। চারদিকের চাপ চাপ রক্তের দাগ দেখিয়ে বলল, তোমরা ঠিক জান কোন ক্ষত নেই?’
উভয় গোয়েন্দাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘নিশ্চয়!’
‘তাহলে এ রক্ত নিশ্চয় কোন দ্বিতীয় ব্যক্তির—সম্ভবত হত্যারারীর, অবশ্য যদি হত্যাকান্ড সত্যিই ঘটে থাকে। এ প্রসঙ্গে ’০৪ সালে ইউট্রেকট-এ ভ্যান জ্যানসেনের মৃত্যুর পারিপাশ্বিক ঘটনার কথা আমার মনে পড়েছে। গ্রেগসন, সে কেসটার কথা তোমার মনে আছে?’
‘না স্যার।’
‘পড়ো-পড়া উচিত। সূর্যের নীচে নতুন কিছু ঘটে না। যা ঘটেছে তা আগেও ঘটেছে।’
কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার হালকা আঙুলগুলিও মৃতদেহের সর্বাঙ্গে যেন উড়ে বেড়াচ্ছে—হাত বুলোচ্ছে, চাপ দিচ্ছে, বোতাম খুলছে, পরীক্ষা করছে। কিন্তু চোখে কোন সুদুরের আভাষ। পরীক্ষার কাজ অত্যন্ত দ্রুত সমাপ্ত হল। এত তাড়াতাড়ি যে এরুপ পুংখানুপুংথভাবে কাজ করা যায় তা ভাবাই যায় না। সব শেষে সে মৃতের ঠোঁট দুটি শুকল, আর দেখল তার পেটেন্ট লেদারের জুতোর তলা।
প্রশ্ন করল, ‘একে একেবারেই সরানো হয়নি তো?’
‘পরীক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন হয়েছে তার বেশী নয়।’
‘এবার একে মর্গে পাঠাতে পার’, সে বলল। ‘আর কিছু জানবার নেই।’
একটা স্ট্রেচার ও চারজন লোক মোতায়েনই ছিল। গ্রেগসনের নির্দেশে তারা ঘরে ঢুকে আগন্তুককে তুলে নিয়ে গেল। তাকে তুলতেই একটা আংটি মেঝের উপর গড়িয়ে পড়ল। লেস্ট্রেড সেটাকে মুঠো করে তুলে হী করে দেখতে লাগল।
‘নিশ্চয় এখানে কোন স্ত্রীলোক ছিল’ সে চেঁচিয়ে উঠল। ‘এটা কোন স্ত্রীলোকের বিয়ের আংটি।’
হাতের তালুতে রেখে আংটিটা সকলেই দেখল। তাকে ঘিরে ধরে আমরাও সেটা দেখলাম। কোন সন্দেহ নেই যে এই খাঁটি সোনার বস্তুটি একসময় কোন বিয়ের কনের আঙুলে শোভা পেয়েছে।
গ্রেগসন বলল, ‘ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো হয়ে উঠল। ঈশ্বর জানেন, আগেই যথেষ্ট ঘোরালো ছিল।’
হোমস বলল, ‘তুমি কি ঠিক জান, এর ফলে ব্যাপারটা সরলতর হল না? ওটাকে হী করে দেখে কিছু জানা যাবে না। তার পকেটে কি কি পাওয়া গেছে?’
সিঁড়ির একটা নিচু ধাপের উপর বোঝাই করা এক-গাদা জিনিসপত্র দেখিয়ে গ্রেগসন বলল, ‘ওখানে সব আছে। লন্ডনের বার্ড কোম্পানির একটা সোনার ঘড়ি, নং ৯৭১৬৩। বেশ ভারী নিরেট সোনার অ্যালবার্ট চেন। কারুকার্ষ-করা সোনার আংটি। সোনার পিন-কুকুরের মস্তকাকৃতি, চোখ দৃষ্টিতে চুনী বসানো। রাশিয়ান লেদারের কার্ড-কেস, তাতে ক্লিভল্যান্ডের এনক জে, ড্রেবারের কার্ড ভরা। তারই অদ্য অক্ষর ই, জে, ডি, লেখা জমাকাপড়ে। কোন টাকার থলি নেই, কিন্তু সাত পাউন্ড তের শিলিং খুচরো ছিল। বোকাশিওর “ডেকা-মেরন” এর একখানা পকেট-সংস্করণ, তার প্রথম পাতায় জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসনের নাম। দু’খানি চিঠি—ই, জে, ড্রেবার ও জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসনকে লেখা।’