বাঞ্চকে আমরা কী বলব? বাঞ্চ মিস মার্কলের অতি প্রিয়, দুজনের মধ্যে দীর্ঘকালীন সম্পর্ক। ওই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা দুচোখের তারায় স্নেহের চাউনি এনে বাঞ্চকে ভালোভাবে দেখলেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে, বাঞ্চের চোখে মুখে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তার মাথায় বসানো ফেল্ট হ্যাটটা বোধ হয় সেকথাই বলছে। এবার বাঞ্চ কি তার গল্পকথা শোনাবেন?
বাঞ্চের কণ্ঠস্বর পরিষ্কার। তিনি শান্তভাবে বললেন–কিছু কথা, মিস। মিস মার্পল সেই কথা শুনে মাথা নাড়লেন। বাঞ্চের গল্প বলা শেষ হয়ে গেল কি? মিস মার্পল বারবার বলার চেষ্টা করলেন–ঠিক আছে, আমি দেখছি, তুমি এত চিন্তা করো না।
বাঞ্চ বললেন-এই জন্যই তো আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম। তুমি কি সব ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ? তুমি তো খুব চালাক তাই না?
-তুমি কি আমার থেকে কম চালাক? এবার বোধ হয় ঠাট্টা তামাশার পালা শুরু হয়ে গেল।
-না, না, আমি না, আমি বোধহয় জুলিয়ানকেও চালাকিতে হারাতে পারব না।
-হ্যাঁ, জুলিয়ান সম্পর্কে আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে, তার মধ্যে এমন একটা সুন্দর বৌদ্ধিক ছাপ আছে তাকে আমি প্রশংসা না করে পারি না।
মিস মার্পলের এই সহজ সরল স্বীকারোক্তিতে মন ভরে গেল বাঞ্চের। স্বামীর প্রশংসা শুনলে কোন স্ত্রী না খুশি হয়?
তাহলে? বাঞ্চ বলে উঠলেন, জুলিয়ানের মধ্যে যে বুদ্ধির ছাপ আছে সেখান দিয়ে বিচার করলে আমি তো একেবারে নির্বোধ, তাই নয় কি?
বাঞ্চ, তোমার মধ্যে একটা সাধারণ বোধবুদ্ধি আছে, তোমার বুদ্ধির চাতুর্য মাঝে মধ্যে আমাকেও মোহিত করে দেয়।
একথা বলে আমাকে রাগিয়ে দেবার চেষ্টা করো না। এতে ভালো হবে না বলছি। আমি জুলিয়ানকে সব কথা জিজ্ঞাসা করতে পারতাম, কিন্তু সে তার ওপর চাপানো কাজের দায়িত্ব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে, আমার কথা মন দিয়ে শুনত না। তাই শেষ পর্যন্ত আমি বাধ্য হয়ে তোমার কাছে এসেছি।…….
এই কথাগুলির মধ্যে এমন একটা স্থির প্রজ্ঞা নির্গত হচ্ছে যে, মিস মার্পল অবাক না হয়ে পারলেন না। তিনি বললেন –একটু শান্ত হয়ে বসো, আমরা মেয়েরা অল্পতেই কেমন অধৈর্য হয়ে যাই। তুমি তো পুরো ঘটনাটা আমার কাছে বলেছ, বাঞ্চ, আমি বুঝতে পারছি না এর সঙ্গে তোমার যোগসূত্রতা কতখানি? এটাকে তুমি কেন একটা দুর্ঘটনা বা অঘটন বলে মনে করছ না?
বাঞ্চ বলে উঠলেন–না, না, একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এত জায়গা থাকতে ওই ভদ্রলোক এখানে কেন এলেন? তিনি কি ওই স্যাংচুয়ারি বা গোপন কুঠুরির সম্পর্কে সব কথা জানতেন? জুলিয়ান যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে, সেটা শুনে আমি তো একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছি। তার মানে ওই ভদ্রলোক পড়াশোনা করা মানুষ। যথেষ্ট শিক্ষাদীক্ষার অহঙ্কার আছে তার, অথচ তিনি জীবন সম্পর্কে এতখানি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেন কেমন করে? যদি উনি সত্যি সত্যি নিজেকে নিজেই গুলি করে থাকেন, তাহলে তিনি তো এখানে বেশিক্ষণ আগে আসেন নি। মৃত্যুর আগে উনি স্যাংচুয়ারি শব্দটা উচ্চারণ করেছেন, সেটা আমার কানে ঢুকে গেছে। স্যাংচুয়ারি বলতে কী বোঝায়? স্যাংচুয়ারি বলতে বোঝায় চার্চের এমন এক গোপন প্রকোষ্ট যেখানে বেরিয়ে গেলে তুমি বাইরের আক্রমণ থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে পারবে। কোনো কিছুই তোমাকে আর স্পর্শ করতে পারবে না। এমন কি এক সময় আইনের লম্বা হাতও স্যাংচুয়ারিতে গিয়ে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারত না। তা হলে ভেবে দেখ, এই চার্চের গঠন সম্পর্কে ওই ভদ্রলোকের কী নিখুঁত ধারণা ছিল। না হলে উনি কী করে বুঝতে পারবেন যে যেখানে একটি গোপন কুঠুরি আছে।
এই কথাগুলি শেষ করে মিস মার্পলের দিকে সম্ভ্রম দৃষ্টিতে তাকালেন বাঞ্চ। মাথা নাড়লেন। বাঞ্চ বলে চললেন–একলেসদের দেখে মনে হল এই ব্যাপারটা সম্পর্কে তারা খুব একটা আগ্রহী নন। হয়তো কোনো কারণে একটা অদ্ভুত উদাসীনতা ওঁদের ব্যক্তিসত্ত্বাকে গ্রাস করেছে তারা ওই ব্যাপার নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে চাইলেন না। এবার আমি ঘড়িটার কথা বলি। মৃত মানুষটির ঘড়ি, সেখানে ডবলিউ আর এস এই শব্দ দুটি বসানো ছিল। পেছনে দিকে কিন্তু ঘড়িটি খোলার পর আমি দেখেছি খুব ছোট ছোট কয়েকটি অক্ষর লেখা আছে, ওয়ালটারকে দেওয়া হয়েছে, বাবার উপহার, একটি তারিখ চোখে পড়েছে। কিন্তু একলেস তো কখনো ওই মানুষটিকে ওয়ালটার নামে ডাকেনি। তারা বারবার উইলিয়াম অথবা বিল–এই নামেই ডাকছিলেন। তাহলে ওয়ালটার কে? এই ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
মিস মার্পলকে মনে হল তিনি বাঞ্চের কথা শুনতে বেশি মাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আসলে যাঁরা মিস মার্পলকে চেনেন, তারা জানেন, তিনি এখন গভীর চিন্তার জগতে পৌঁছে গিয়েছেন।
বাঞ্চ গড়গড়িয়ে বলতে থাকেন–আমরা একসময় একজন মানুষকে তার ধর্মদত্ত নামে ডেকে থাকি না। আশা করি তুমি আমার কথার আসল অর্থ বুঝতে পেরেছ। হয়তো ওই ভদ্রলোককে উইলিয়াম নামেই ডাকা হত, অথবা ওকে বগরি কিংবা ক্যারটস নামেও ডাকা হতে পারে। কিন্তু তুমি যদি কারোর বোন হও, তাহলে তুমি কি তার আসল ডাক নাম কটা জানবে না? উইলিয়াম অথবা বিলকে ওয়ালটার নামে ডাকা যেতে পারে কি? আমার কেবলই মনে হচ্ছে……..