আবার কিছুক্ষণ সীমাবদ্ধ নীরবতা। শ্রীযুক্ত একলেস বলে উঠলেন–সে কি কোনো খবর দিয়েছে? তার মুখ থেকে উচ্চারিত শেষ শব্দগুলি কী ছিল? তার মধ্যে কোনো লুকোনো সংকেত ছিল কি?
তার চোখ দুটো হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই উজ্জ্বল চোখ মেলে তিনি বাঞ্চকে পর্যবেক্ষণ করলেন। শ্রীমতী একলেসকেও দেখা গেল বাঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকতে। এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তিনি যে মনে মনে কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন সেটা তাঁর আচরণে পরিস্ফুটিত হল। যদিও তিনি প্রাণপণ চেষ্টায় তার মনের মধ্যে হঠাৎ উথলে ওঠা এই উত্তেজনাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর অভিব্যক্তির এই হঠাৎ পরিবর্তনে বাঞ্চ অবাক হলেন।
বাঞ্চ শান্তভাবে বললেন না, তিনি একেবারে মৃতার্ত অবস্থায় এইভাবে এসে পৌঁছেছিলেন। আর তার মুখ থেকে একটি শব্দ বেরিয়েছে–স্যাংচুয়ারি অর্থাৎ অরণ্য আবাস। এই শব্দের অভ্যন্তরে কোন্ গূঢ় অর্থ লুকিয়ে আছে তা আমি বুঝতেই পারছি না।
শ্ৰীমতী একলেস অবাক হওয়া কণ্ঠস্বরে বললেন–স্যাংচুয়ারি? এই শব্দটা ও বলল কেন?
শ্রী একলেস বাধা দিয়ে বলার চেষ্টা করলেন-আমার মনে হয়, এটা বোধহয় খুব পবিত্র একটা জায়গা হয়তো কোনো এক পাপ থেকে সে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল। তার মনের ভেতর অনুশোচনার আগুন জ্বলে উঠেছিল।
বাঞ্চ বললেন-মৃত্যুর আগে ওই ভদ্রলোক আরও কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেই চেষ্টা তার সফল হয়নি। তিনি প্লীজ এই শব্দটা বলেছিলেন। তারপর তাঁর মুখ থেকে আর একটি শব্দও বেরিয়ে আসেনি।
শ্রীমতী একলেস রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। তারপর একটু হেঁকে বললেন–ওই আমার প্রিয় ভাইটি, আমি ব্যাপারটা কী করে সহ্য করব বুঝতেই পারছি না।
বেশ বোঝা গেছে এই ঘটনাতে তিনি বিহ্বল হয়ে উঠেছেন।
এবার তার স্বামীর পালা, তিনি বললেন-পান, এই ব্যাপারটাকে শান্তভাবে মানতেই হবে। সব জিনিস তো আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না। বেচারি উইলি, এখন সে তো শান্তির শয্যায় শুয়ে আছে। এসো, আমরা ব্যাপারটা এইভাবে ভাববার চেষ্টা করি। শ্রীমতী হারমন, আশা করি আমাদের আগমনে আপনার দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন ঘটেনি। আমি জানি একজন ভাইকারের স্ত্রীকে কত কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাতে হয়, ব্যাপারটা আমাদের স্পষ্ট জানা আছে।
এবার করমর্দনের পালা। তারপর একলেসরা যাবার জন্য এগিয়ে গেলেন। তাদের আচরণের ভেতর দ্রুততার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেতে যেতে শ্রীমতী বলে উঠলেন–আর কিছু কি বলার বাকি থেকে গেল? আচ্ছা, আপনি কি তার গায়ে কোটটা দেখেছেন?
বাঞ্চ অবাক হওয়া কণ্ঠস্বরে শুধোলেন–কোট? কী বলতে চাইছেন আপনি?
শ্রীমতী একলেস বললেন–না, অনেক সময় মানুষ তার পছন্দের পোশাক পরেই আত্মহত্যা করে। বুঝতে পারছেন তো–এখানে আবেগ কাজ করে।
-তার কাছ থেকে একটা ঘড়ি পাওয়া গেছে, আর একটা ওয়ালেট, সেখানে রেলের টিকিট ছিল, এছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। আমি সব কিছু সার্জেন্ট-এর হাতে তুলে দিয়েছি।
থেমে থেমে কথা বললেন বাঞ্চ।
শ্ৰীযুক্ত একলেস বললেন–ঠিক আছে, তাহলে এবার আমাদের যেতে হবে। আমার মনে হয় ওই ওয়ালেটের মধ্যে বোধ হয় ওর ব্যক্তিগত কাগজগুলো ছিল।
বাঞ্চ বললেন-না, সেখানে একটা এক পাউন্ডের নোট ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আর কিছু না।
–কোনো চিঠি ছিল না? চিঠি, অথবা চিরকূট?
এই প্রশ্ন শুনে বাঞ্চ মাথা নাড়লেন।
–ঠিক আছে, আপনাকে আবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি শ্রীমতী হারমন। যে কোটটা সে পরে বেরিয়েছিল সেটা কোথায় গেল? সার্জেন্টের হাতে গেল কি?
বাঞ্চ সব কিছু মনে করার চেষ্টা করছিলেন।
তিনি বললেন–না, আমার তো মনে পড়ছে না, আমি আরও একবার পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখার চেষ্টা করি। ডাক্তার আর আমি তার কোট খুলে দিয়েছিলাম। যাতে ওই ক্ষতচিহ্নটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়।
এবার তিনি ঘরের চার পাশে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন–কোটের ওপর রক্তের দাগ কালচে হয়ে লেগে ছিল। আমি সেটা ওপরে নিয়ে গিয়েছিলাম, পরিষ্কার করার জন্য। এখন আমার বেশ স্পষ্ট মনে পড়ছে।
–আপনি যদি কিছু মনে না করেন, শ্রীমতী হারমন, তাহলে কষ্ট করে আপনাকে একবার সেখানে যেতে হবে। ওই কোটটাই হল মৃত ব্যক্তিটির শেষ স্মৃতিচিহ্ন, বুঝতেই তো পারছেন এই ব্যাপারটা আমার স্ত্রীর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওই কোটটা ছাড়া আর কোনো স্মৃতি আমরা ধরে রাখব বলুন তো?
বাঞ্চ বললেন–ঠিক আছে, আগে কোটটা পরিষ্কার করতে হবে। তার গায়ে রক্তের কলঙ্ক রেখা লেগে রয়েছে। এই কথা শুনে ভদ্রলোক হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন–আমি খুবই দুঃখিত, যে মেয়েটি আমার সংসার দেখাশোনা করে সে ওই কোটটাকে নিয়ে চাদরে বেঁধে রেখেছিল। আর একটু হলেই কোটটাকে সে বেঠকখানায় পাঠিয়ে দিত। আমার সৌভাগ্য তেমন ঘটনা ঘটেনি। অনেকক্ষণ সময় লাগল ওটাকে খুঁজে বার করতে। এই দেখুন, আমি এই কোটটা নিয়ে এসেছি। এটাকে একটা বাদামি কাগজে মুড়িয়ে আপনাদের হাতে তুলে দিই কেমন?
বাঞ্চের এই প্রয়াসে ভদ্রমহিলা অথবা ভদ্রলোকের চোখে মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। এবার বিদায় নেবার পালা। একলেস দম্পতি জীপে উঠে চার্চ প্রাঙ্গন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।