বাঞ্চ তির্যক কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন–না, না, সে ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমাকে তো এখন অপেক্ষা করতেই হবে। আসলে ওনাদের মধ্যে আমি কিছু গোপন শব্দ লুকিয়ে রেখেছি। সেসব বলে দেব। এই কথায় সার্জেন্ট হায়াতের চোখে মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি বললেন–ঠিক আছে, আপনি না হয় একটুখানি সময় অপেক্ষা করুন।
বাঞ্চ বললেন–আমি ভাবছি, এটা বোধহয় একটা হত্যার ঘটনা নয়, এর অন্তরালে অন্য কোনো রহস্য ঘনীভূত হয়ে আছে।
ভিকারেজ গেটের মধ্যে দিয়ে একটা গাড়ি প্রবেশ করল। সার্জেন্ট হায়াত উদাসীন ভাবে গাড়িটির দিকে তাকলেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য করলেন–মনে হয় শ্রী এবং শ্রীমতী একলেস এখানে এসে গেছেন, ম্যাডাম, ওঁরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন নিশ্চয়ই।
এই কথা শুনে ক্ষণকালের জন্য বাঞ্চ কী যেন চিন্তা করলেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে তিনি মনে মনে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করছেন। আসলে তাঁকে এখন একটা শোকাবহ বাতাবরণের সামনে এসে দাঁড়াতে হবে। এই অস্বস্তিকর মুহূর্তটিকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি জানেন তা সম্ভব নয়। বাঞ্চ অনুচ্চ কণ্ঠস্বরে বললেন, –আমার মনে হয়, জুলিয়ানকে ডেকে পাঠানো দরকার। জুলিয়ান আমাকে সাহায্য করতে পারবে। যখন মানুষের মনের আকাশে শোকের মেঘ উড়ে যায়, তখন একজন পাদরির সাহায্য দরকার হয়।
শ্রী এবং শ্রীমতী একলেস-কে দেখে মনে হল বাঞ্চ যেমনটি অনুমান করেছিলেন তারা ঠিক তেমনটি। বাঞ্চ তাদের দিকে ভালো করে তাকালেন। কেমন একটা অনুভূতির সঞ্চারণ ঘটে গেল তার মনের মধ্যে। শান্তভাবে তিনি ওই দম্পতিকে অভ্যর্থনা জানালেন। কিন্তু তার মনের ভেতর বিস্ময়ের উদ্রেক হল। মিস্টার একলেসকে আমরা একজন সুদেহের অধিকারী পুরুষ বলে মনে করতে পারি। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের দেখলে মনে হয় তারা সবসময় সুখের সাগরে অবগাহন করতে ভালোবাসে। এই বসুন্ধরাতে কোনো দুঃখ আছে, সেটা তারা ভুলে থাকতে ভালোবাসেন। তাকে দেখে সেকথাই মনে হল বাঞ্চের, এবার শ্রীমতী একলেসের কথা বলি, একলেসকে দেখলে কেমন অগোছালো স্বভাবের মহিলা বলে মনে হয়। তাঁর মুখটা গোলাকৃতি, আকারে ছোটো, তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে একটা তীক্ষ্ণতা আছে, কিন্তু সেটা খুবই মিনমিনে এবং তার মধ্যে ভেসে উঠছে অনিশ্চয়তা।
তিনি বললেন–মিসেস হারমন, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এটা আমাদের কাছে কত বড়ো একটা শোকের ঘটনা।
বাঞ্চ বলে উঠলেন–হ্যাঁ, আমি তা অনুমান করতে পারছি। কিন্তু যেটা ঘটে গেছে সেটাকে তো আটকাবার কোনো উপায় নেই। এখন আসুন, আমরা ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করি। অনুগ্রহ করে আপনি একটু বসবেন কি? এই সময় আপনি কি কিছু একটা খাবেন? এখন কি চা খাওয়ার সময় হয়ে গেছে?
বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে অসংলগ্ন কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বাঞ্চ তার হারানো ব্যক্তিত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় মেতে উঠেছেন। শ্রীযুক্ত একলেস হাত নেড়ে বললেন-না, না, এখন আমরা কিছুই খাব না। আমাদের যে আপনি খেতে বলেছেন এ জন্য আপনাকে আমি অজস্র ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এখন কিছু কথা বলতে হবে। বেচারি উইলিয়াম কী বলেছে সেটা আমাদের জানা দরকার। তার সম্পর্কে আপনি কোনো খবর জানতে পেরেছেন কি?
শ্রীযুক্ত একলেসের কণ্ঠস্বরের ভেতর কৌতূহল ঝরে পড়ছে। এবার শ্রীমতী একলেসের পালা। তিনি বললেন–আহা, বেচারি ভাইটি দীর্ঘদিন বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছে। আমার মনে হয় ওর বোধহয় এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল যেগুলোকে আমরা ঠিক মতো ব্যাখ্যা করতে পারব না। জীবনে চলার পথে অনেক সময় আমাদের নানা অনভিপ্রেত ঘটনার সামনে এসে দাঁড়াতে হয়। এমন কিছু মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় যাদের অতীতটা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে আমার ভাইটি খুব শান্ত স্বভাবের হয়ে যায়। সবসময় নিজের তৈরি করা জগতের মধ্যে বাস করতে ভালোবাসত। আসলে যখন সে বাড়িতে ফিরে আসে এখন তার চরিত্রের মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তনটা আমার নজরে পড়েছিল। বারবার সে বলত, এই পৃথিবীটা তার পক্ষে বাসযোগ্য গ্রহ নয়। এখানে সে কিছুই করতে পারবে না। হতভাগ্য! এছাড়া আর আমি কী বলতে পারি তাকে ছোটোবেলা থেকেই আমার ভাইটি ছিল এমন আবেগপ্রবণ আর পালটানো মনোভাবের। সত্য, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে প্রতি মুহূর্তে আমাদের কত রক্তাক্ত সংগ্রামের সামনে দাঁড়াতে হয়। কত প্রতিবন্ধকতার সামনে এসে বসতে হয়, তার সঙ্গে লড়াই করার মতো সাহস থাকা দরকার। তা বলে সে নিজেকে এইভাবে বিসর্জন দেবে, আমি তো ভাবতেই পারছি না।
বাঞ্চ দুজনের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল, তখন সেখানে বিরাজ করছে সীমাহীন নৈঃশব্দ্য। আসলে মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যখন ভাষারা সব হারিয়ে যায়।
শ্ৰীমতী একলেস বললেন-আমার স্বামীর রিভলভারটা ঘিরেই এই ঘটনাটা ঘটে গেছে। কিন্তু রিভলভারটা সে যে নিয়েছে সেটা কি আমরা জানতাম না। সে বাসে চেপে এখানে এসেছে। এখানে একা কেন, সেটাও আমি বুঝতে পারছি না। সে তো এই ঘটনাটা আমাদের বাড়িতেও ঘটাতে পারত।
মিস্টার একলেস বিড় বিড় করে বলে উঠলেন–হতভাগ্য, তার জন্য আমার অনুতাপ হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন-এই কাণ্ডটা করা তার পক্ষে উচিত। নি।