হঠাৎ বাঞ্চ বলে উঠলেন–উনি অস্ফুটভাবে একটি শব্দ বলেছেন, স্যাংচুয়ারি!
ডাক্তার ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন-স্যাংচুয়ারি?
বাঞ্চ বললেন–এখানেই জুলিয়ান এসে গেছে। তিনি এগিয়ে গেলেন, তারপরে বললেন তার স্বামীকে–জুলিয়ান, তাড়াতাড়ি এখানে এসো।
রেভারেন্ড জুলিয়ান হারমন ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। তার চেহারার মধ্যে বৌদ্ধিক ছায়া আছে। মনে হয় তিনি বোধ হয় যথেষ্ট প্রাজ্ঞ এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। আর এই প্রাজ্ঞতা তার মধ্যে এমন একটা পরিমিত বোধের জন্ম দিয়েছে, যা তার বয়সটাকে অকারণে বাড়িয়ে তুলেছে।
জুলিয়ান হারমন বললেন–কী হয়েছে? তাঁর হাবভাবের মধ্যে অদ্ভুত এক চঞ্চলতা প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও তিনি সেটাকে ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তিনি ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন।
বাঞ্চ অতি অল্প শব্দ খরচ করে পুরো ঘটনাটা স্বামীর কাছে ব্যক্ত করলেন।
বাঞ্চ বললেন–চার্চের ভেতর ওই মৃতার্ত মানুষটি পড়েছিলেন, ডাক্তার মনে করছেন তাকে গুলি করা হয়েছে। জুলিয়ান, আমার মনে হয় উনি ঘোরে তোমার নামই বলছিলেন।
সোফার কাছাকাছি জুলিয়ান এসে দাঁড়ালেন। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহত ব্যক্তিটিকে লক্ষ্য করলেন। আহা, হতভাগ্য মানুষটি, জুলিয়ান নিজের মনে বললেন। মাথা নেড়ে বললেন–না, আমি এই জীবনে কখনো এই মানুষটিকে দেখিনি। নাহ, কোনো জায়গাতে এনার সাথে আমার যোগযোগ হয়েছিল বলে মনে পড়ছে না।
এই সময় ওই মৃতপ্রায় মানুষটির চোখ দুটি খুলে গেল। তিনি একবার ডাক্তারের মুখের দিকে তাকালেন, তারপর জুলিয়ান হারমনকে দেখলেন। এবার বোধহয় বাঞ্চের পালা। চোখের তারায় কী যেন একটা উত্তেজনা ফুটে উঠেছে, তিনি বাঞ্চের মুখের দিকে তাকালেন। ডাক্তার গ্রিফিথস সামনের দিকে এগিয়ে এলেন।
উনি বললেন–আসল ঘটনাটা কিন্তু আমিই জানি।
তার চোখ দুটি বাঞ্চের চোখের ওপর নিবদ্ধ। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর একেবারে ভেঙে গেছে। তিনি বললেন–প্লীজ…..প্লীজ…..
তারপর? সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত কম্পন দেখা দিল। এক মুহূর্তের মধ্যে তাঁর প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে কোথায় যেন উড়ে গেল।
সার্জেন্ট হায়াত পেনসিলটাকে নিয়ে কী যেন চিন্তা করছেন। নোটবুকের ওপর তাকিয়ে আছেন।
শ্রীমতী হারমন, তাহলে এইটুকুই আপনারা জানেন, তাইতো? এর থেকে আর কোনো কিছু বেশি খবর কি আমি আশা করতে পারি না?
বাঞ্চ বললেন –এটাই হল গল্প, তার কোটের পকেট থেকে এইসব জিনিস পাওয়া গেছে।
সার্জেন্ট হায়াত তাকালেন টেবিলের দিকে, তার মনে এখন নানা প্রশ্নের ভিড়। টেবিলে সাজানো আছে একটা ওয়ালেট, একটা পুরোনো দিনের ঘড়ি, এখানে ডবলিউ এফ এই দুটি অক্ষর খোদাই করা আছে। লন্ডনে যাবার রিটার্ন টিকিট, এছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং এই দ্রব্যগুলি দেখে ওই ভদ্রলোকের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে কোনো কথাই জানা যাবে না।
বাঞ্চ জিজ্ঞাসা করলেন–আপনারা কি বুঝতে পারছেন, এই ভদ্রলোক আসলে কে?
জনৈক মিস্টার এবং মিসেস একলেস স্টেশনে ফোন করেছিলেন। আমার মনে হয় এই ভদ্রলোক বোধহয় মিসেস একলেসের ভাই, এনার নাম বোধহয় স্যান্ডবর্ন, ইনি প্রথম থেকেই খুব দুর্বল চিত্তের মানুষ ছিলেন। বেশ কিছু দিনের জন্য তার মধ্যে এক অদ্ভুত উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল। তিনি ক্রমশ খারাপের দিকে এগিয়ে যান। একদিন আগে উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। আর ফিরে যাননি। মনে হয় ওনার সঙ্গেই বোধহয় রিভলভারটা ছিল।
-নাহ, আমার মনে হয় এটা হয়েছে আত্মঅবদমন থেকে। যে কোনো কারণে উনি বোধহয় খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তাই এই জীবনের ভার আর বহন করতে চাননি। অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে যায়। হতাশা থেকে তো মানুষ জীবন সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে ওঠে।
বাঞ্চ ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–না, আমি জানতে চাইছি উনি এখানে এলেন কেন? রহস্যটা আমার কাছে বড়ো অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে।
সার্জেন্ট হায়াত এই ব্যাপারে কী জবাব দেবেন? তিনি পুরোনো দিনের পদ্ধতি অনুসারে বললেন–তিনি এখানে এসেছেন, আমার জানা আছে।
আবার অধৈর্য হয়ে উঠলেন বাঞ্চ। জানতে চাইলেন, সেটা তো আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে বেছে বেছে এই চার্চেই এলেন কেন? এই রহস্যটা আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না।
হায়াত বললেন–সত্যি কথা বলতে কী মিসেস হারমন, ব্যাপারটা আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। এর অন্তরালে কোন কারণ লুকিয়ে আছে সেটা জানার চেষ্টা করতে হবে। তবে যদি মনের ভারসাম্য হারিয়ে যায়….
বাঞ্চ তার কথা শেষ করতে দিলেন না। বোঝা গেল তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। তিনি বললেন–সে যা হোক, আপনি কিন্তু কিছুতেই আমার মনকে শান্তি করতে পারছেন না। কোনো ব্যক্তি কেন বাস ধরে এমন একটি ছোট্ট শহরতলিতে এসে পৌঁছবেন, তিনি যেখানকার কিছুই জানেন না, ঠিক তো?
বাঞ্চের কথার মধ্যে বুদ্ধিমত্তার ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সার্জেন্ট হায়াত বললেন–না, মনে হচ্ছে এই জায়গাটা সম্পর্কে তিনি খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলেন না। এবার তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে কিছুটা ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিমা জেগে উঠেছে। অকারণে খুক খুক করে কাশলেন তিনি। নিজের দুটি পায়ের ওপর ভর দিয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই মিস্টার এবং মিসেস একলেস এখানে এসে পৌঁছবেন। ম্যাডাম, আপনি আর একটুখানি সময় অপেক্ষা করুন, আমার মনে হচ্ছে আসল তথ্যটা ওই দম্পতির কাছ থেকেই জানা যাবে। আশাকরি একটুখানি সময় অপেক্ষা করতে আপনার কোনো আপত্তি থাকবে না।