তারপর? কী এক তন্দ্রাচ্ছন্নতা এসে গ্রাস করল ওই মানুষটিকে, তিনি আবার কেমন যেন হয়ে গেলেন। শ্বাসের শব্দ শোনা গেল। চোখ দুটি আবার বন্ধ হয়ে গেল, আরও একবার বাঞ্চ ওই মানুষটিকে বাঁচাবার চেষ্টা করলেন, তার কবজিতে হাত রাখলেন, কত নাড়ির স্পন্দন বোঝার চেষ্টা করলেন, কী আশ্চর্য! নাড়ির গতি এখন আরও কমে গেছে, মাঝে মধ্যে থেকে থেকে নাড়ির স্পন্দন শোনা যাচ্ছে। এবার তাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
তিনি বললেন–নড়বার চেষ্টা করবেন তো তাহলে ফল মারাত্মক হবে। আমি দেখছি। কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
এই কটি কথা বোধহয় ওই মৃতার্ত মানুষের কানে পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি অতি কষ্টে চোখ খোলার চেষ্টা করলেন। না, এবার বোধহয় আর দেখতেই পাবেন না, তবু দেখবার চেষ্টা করলেন। পূর্ব জানলা দিয়ে ছিটকে ছুটে আসা আলোর উৎসই তাকে এখন বাঁচিয়ে দিতে পারে। তিনি বিড়িবিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, শব্দগুলো এত অস্পষ্ট যে বাঞ্চ তার অর্থ বুঝতেই পারলেন না। বাঞ্চ ভাবলেন এই মানুষটির মধ্যে বোধহয় একটা রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু? এটা কি তার স্বামীর নাম উচ্চারিত হচ্ছে?
উনি বললেন–জুলিয়ান? আপনি কি এখানে এসেছেন জুলিয়ানকে খুঁজে পাবার জন্য?
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ভেসে এল না মৃতপ্রায় ওই মানুষটির মুখ থেকে। ভদ্রলোক শুয়ে আছেন, নিশ্চল, নিশ্চপ, চোখ দুটি বোজান, এখনও অতি মৃদু ভাবে নাড়ি স্পন্দিত হচ্ছে। তার মানে এখনও প্রাণ আছে। অতএব বাঞ্চকে এবার সচল এবং সজাগ হতেই হবে।
বাঞ্চ উঠে দাঁড়ালেন, অতি দ্রুত চার্চ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি তাকালেন তার ঘড়ির দিকে, সময়টা দেখে ঘাড় নাড়লেন উৎসাহের আতিশয্যে। তার মানে? ডাঃ গ্রিফিথস তখনও হয়তো তার সার্জারিতে বসে আছেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি সেখানে পৌঁছে যেতে পারবেন। অতি দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন শ্রীমতী বাঞ্চ। এখন আর নষ্ট করার মতো সময় নেই, এখানে অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না, সোজা পৌঁছে গেলেন ডাক্তারের সার্জারি রুমে।
বাঞ্চ হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন–স্যার আপনাকে এখনই আসতে হবে, ওদিক একটি মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। একটু পরীক্ষা করি দেখুন ওই মৃতার্ত মানুষটিকে। পরীক্ষায় কী জানা গেল বোঝা যাচ্ছে না।
ডাক্তার বললেন–এই মানুষটিকে এখনই এখান থেকে ভিকারেজে নিয়ে যেতে হবে, সেখানে গেলে আমি আরও ভালোভাবে ওনার চিকিৎসা করতে পারব।
–কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব?
বাঞ্চ বললেন–ঠিক আছে। আমিও আপনার পাশাপাশি থাকব। আমি আপনার হাতের কাছে সব কিছু গুছিয়ে দেব। আমি হাবার্ট এবং জোনসকেও সঙ্গে পাব। আমার মনে হয় ওদের এখনই ডাকা উচিত। না হলে মানুষটিকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
-তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমি ভিকারেজকে এখনই ফোন করছি, একটা অ্যাম্বুলেন্স আনতে হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যদি বেশি সময় নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে হয়তো….
ডাঃ গ্রিফিথস তার কথা শেষ করলেন না। তিনি অতি দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার অভিব্যক্তির মধ্যে এখন একটা ভয়চকিত ভাব বিরাজ করছে, বাঞ্চের বুঝতে অসুবিধা হল না যে, আহত লোকটির আয়ু আর বেশিক্ষণ নেই।
বাঞ্চ বললেন–রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে?
ডাঃ গ্রিফিথস মাথা নাড়লেন। তিনি বললেন-হা, কতক্ষণ ধরে উনি এখানে পড়ে আছেন?
বাঞ্চ বললেন–আমার মনে হয়, সারারাত ধরেই উনি এইভাবে পড়ে আছেন। আসলে সকাল বেলা হাবার্ট চার্চের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে, কাজ শুরু করে, কিন্তু আজ এখনও তো সে আসেনি।
পাঁচ মিনিট পরে ডাঃ গ্রিফিথসের কার্য ধারা শুরু হয়ে গেল। তিনি ইতিমধ্যে সব কিছু শেষ করে এসেছেন। তিনি ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লেন। আহত লোকটি তখনও মাটিতেই শুয়ে আছেন। তাঁকে সোফার ওপর শুইয়ে দেওয়া হল। গায়ের ওপর কম্বল চাপিয়ে দেওয়া হল। বাঞ্চ তখনই কাজ করতে শুরু করেছেন, তিনি জল পূর্ণ একটি পাত্র নিয়ে এলেন, ডাক্তারের নির্দেশমতো লোকটির ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে লাগলেন।
গ্রিফিথস বললেন–ঠিক আছে, আমি এখনই একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার চেষ্টা করছি। তবে পুলিশকে একটা খবর তো দিতেই হবে।
ডাঃ গ্রিফিথস উঠে দাঁড়ালেন। রোগীর দিকে তাকালেন, চোখ দুটি তখনও বন্ধ। তিনি আবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন, বেশ বোঝা যাচ্ছে কোনো কারণে স্নায়বিক বিকার ঘটে গেছে ওই মানুষটির। কারণটা কী? তা জানার চেষ্টা করতে হবে কি?
গ্রিফিথস বললেন–না, এই লোকটিকে গুলি করা হয়েছে, কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে এই গুলি করার ঘটনা বেশিক্ষণ আগে ঘটেনি। তিনি রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানটি ঢাকবার চেষ্টা করেছেন, আর যাতে রক্ত না বের হয় তাই ওই জায়গাটাকে ব্যান্ডেজ বাঁধার ব্যর্থ প্রয়াস করেছেন।
বাঞ্চ জানতে চাইলেন–এই ঘটনাটা কখন ঘটেছে বলে মনে হয়? আর কী ভাবে আপনি এত কথা বলতে পারছেন?
আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আমাকে এই সিদ্ধান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। আমরা জানি যদি কোনো মানুষ আহত হয় তাহলে সে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে, শুধু তাই নয়, সেই মরিয়া ভাবটা চোখে মুখে ফুটিয়ে রাখারও চেষ্টা করে। কিন্তু এইক্ষেত্রেও দেখে মনে হয় সে বোধহয় আহত হয়নি, যেন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তার শরীরটা একেবারে এলিয়ে যায়। আমার মনে হচ্ছে এই ভদ্রলোকের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু আমার অনুমান ওনাকে চার্চের ভেতর গুলি করা হয়নি। ওনাকে বোধহয় অন্য কোথাও গুলি করা হয়েছে। অথবা উনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করে থাকতে পারেন, তার পর রিভলভারটা ফেলে দিয়েছেন। চার্চের দিকে এগিয়ে গেছেন আহত পায়ে, বেশিক্ষণ আগে এই ঘটনা ঘটেনি, আমার মনে হয়, এটা বোধ হয় খুব টাটকা ঘটনা।