- বইয়ের নামঃ ফাইনাল কেসেস
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনী
ফাইনাল কেসেস
১. স্যাংচুয়ারি
ফাইনাল কেসেস (মিস মার্পল)
স্যাংচুয়ারি
০১.
দুহাতে ফুটন্ত ক্রিসেনথেমাম নিয়ে ভাইকারের বউ প্রবেশ করলেন ভিকারেজের ঘরের মধ্যে। তার জুতোর ডগায় লেগে আছে শিশিরস্নাত মৃত্তিকার কণা, শুধু তাই নয়, তাঁর নাকের অগ্রে সাত সকালের নিষ্পাপ ভালোবাসার স্পন্দন, কিন্তু এ দুটি বিষয় সম্পর্কে তিনি মোটেই অবহিত নন।
দরজা খুলতে সামান্য পরিশ্রম করতে হল তাকে। অবাধ্য দরজা কিছুতেই খুলবে না বুঝি, দুষ্টু বাতাস উড়িয়ে দিতে চাইল তাঁর মাথার ওপর তেরছাভাবে বসানো ফেল্টের হ্যাট। অতি কষ্টে হ্যাটকে সামলালেন তিনি। বসে ডাকলেন-বথার।
উৎসাহী জননী ডিয়ানা মিসেস হারমনের নামটা পালটে বাঞ্চ করেছেন তার কিশোরী বেলায়। কিন্তু কেন, সে খবর আমরা জানি না। এখন তার নামের সাথে এই শব্দটি জুড়ে গেছে। দুহাতে ধরা ক্রিসেনথেমাম, এগিয়ে গেছে পথ চার্চ প্রাঙ্গনের দিকে, তিনি এগিয়ে গেলেন চার্চের দরজার পাশে।
নভেম্বরের বাতাস এখন মৃদুমন্দ বইছে। আর্দ্রতার চিহ্ন মাখা। আকাশের সেখানে এখানে দুষ্ট কালো মেঘের দল ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, চোখের পরতে নীলাভ রেখা। চার্চের ভেতর বাতাবরণ এখন অন্ধকারপথে শীতার্ত আর্তনাদ, সার্ভিস মুহূর্ত ছাড়া কখনো তাকে কাঙ্ক্ষিত উত্তাপ দেওয়া হয় না।
বাঞ্চ বলে উঠলেন–ধ্যুৎ, মনে হচ্ছে এই শীতে বোধহয় আমি আর বাঁচব না।
অভ্যাস মতো সংগ্রহ করেছেন ফুল সাজানোর জিনিসপত্র–ফুলদানি, জল, ঢাকা দেবার টুকরো, তারপর বাঞ্চ মনে মনে বললেন, লিলিফুল থাকলে ভালো হত, এই ক্রিসেনথেমাম দেখে আর ভালো লাগছে না আমার। তবুও অভ্যাসমতো আঙুল চালিয়ে ফুলকে সুসজ্জিত করার চেষ্টায় মেতে উঠলেন তিনি।
আজ এই সন্ধ্যার মধ্যে কোনো কিছুকেই আমরা মৌলিক অথবা কৃত্রিম বলতে পারি না। বাঞ্চ হারমেন হয়তো নিজের জীবনেও মৌলিকত্বকে সেভাবে আঁকড়ে ধরতে ভালোবাসেন না। তার কাজ কর্মের মধ্যে শৈল্পিক অনুভূতির ছাপ নেই কিন্তু তার মধ্যে এমন একটা আবেশ আছে যাকে আমরা গৃহস্থালি বলতে পারি। আর আছে অনুপম উপস্থাপনা। সাবধানে ফুলদানিটিকে ধরলেন তিনি। তারপর এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে, এবার তাকে বেদী পর্যন্ত পৌঁছতেই হবে। বেদীতে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের সূর্যের ঝলকানি চোখে পড়ল।
পূর্বদিকের জানলা পথে হাওয়া ঢুকে পড়েছে, তবে তার প্রবেশ পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ঘষা কাঁচের দল। নীল এবং লালের সমাহার, কোনো এক ভিক্টোরিও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির দান, এর ফলে সেখানে একটা অদ্ভুত আবছা আলোর সৃষ্টি হয়েছে। বাঞ্চ ভাবলেন, অনেকটা দামী মণিমুক্তোর মতো, ভাবনারা হারিয়ে গেল। তিনি ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এবার তাঁকে সিঁড়িতে পা রাখতে হবে।
নীচু হয়ে সাবধানে ফুলগুলো সাজিয়ে দিলেন, ঘাড় নীচু করে কিছু যেন বলার চেষ্টা করলেন–একী? কালো মতো বস্তুটা কী? এখানে মানুষের দেহ? তিনি অবাক হলেন। হাঁটু মুড়ে বসলেন ওই পুরুষ মানুষটির পাশে। তারপর ধীরে ধীরে মানুষটিকে উল্টে দিলেন। এবার মনে হল তিনি যেন কিছু একটা অনুমান করতে পারছেন। কোনো বিপদ ঘটে গেছে কি? হাত দিলেন তার নাড়ির ওপর, অতি মৃদু স্পন্দনে, এত মৃদু যে সহসা তা উপলব্ধি করা যায় না। তার মানে? এখনও কি লোকটা বেঁচে আছে? তার সমস্ত মুখে ভয়ার্ত সবুজের আবরণ। নাঃ এই মানুষটি মৃতার্ত, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
লোকটিকে দেখে মনে হয় তার বয়স পঁয়তাল্লিশের এপাশ ওপাশ, ঘন অথচ মলিন পোশাক তার পরিধানে। ভদ্রমহিলা কী আর করবেন? আবার নাড়ির ধ্বনি অনুভব করার চেষ্টা করলেন। মনে হল, এখন বোধ হয় তাকে কিছুটা শুশ্রূষা করা দরকার। তিনি এই মৃতপ্রায় লোকটির বুকে ঘুষি মারার চেষ্টা করলেন, যাতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হতে পারে। আবার ভালো ভাবে তার মুখের দিকে তাকালেন। কী আশ্চর্য, তার বুকের ওপর এমন শক্ত করে কাপড় বাঁধা কেন? মনে হচ্ছে, কেউ কি তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে? মস্ত বড়ো এক টুকরো কাপড়। কিছুই বুঝতে পারছেন না শ্রীমতী তবু রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করছেন। তার মানে? ওই কালচে রঙা বস্তুটি কী? রক্ত শুকিয়ে এমন কালচে হয়ে গেছে? এবার বাঞ্চ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। কোনো রকমে বসে পড়লেন, ভয়ের ছবি আঁকা হল তার সমস্ত তনু বাহারে।
এবার লোকটির চোখের দিকে তাকালেন। বন্ধ চোখ, বেশ বোঝা যাচ্ছে, উনি বোধহয় প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন। একটু বাদে ভদ্রলোক চোখ দুটি খুললেন, তাকালেন বাঞ্চের মুখের দিকে, সেই চোখের তারায় কোথাও কোনো অনুভূতির চিহ্ন নেই, না, ভয় অথবা উত্তেজনা বা সাহস অথবা অবদমন, কিছুই চোখে পড়ল না কিন্তু চোখ দুটি এখনও জীবন্ত এবং সেখানে বুদ্ধিমত্তার ছাপ আছে। ভদ্রলোক ঠোঁট খুলে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। বাঞ্চ নীচু হয়ে তার কথা শুনতে চাইছেন। কী আশ্চর্য, একটি মাত্র শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে, ফিসফিসানি শব্দ–স্যাংচুয়ারি, অর্থাৎ অরণ্য আবাস।
এই শব্দ কী দারুণ এক অর্থ বহন করছে। বাঞ্চ ভাবলেন, কিন্তু এই অর্থের মধ্যে কী লুকিয়ে থাকতে পারে? একটু বাদে ওই ভদ্রলোক আবার কাঁপা কাঁপা শব্দে বললেন স্যাংচুয়ারি, মানে অরণ্য আবাস।