বাড়িটা বন্ধক রাখা আছে?
নিক এবার কিছুটা বিমর্ষ গলায় বলে–আমি বাধ্য হয়েছিলাম। পরপর কয়েকটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেল। একটার পর একটা। প্রথমে আমার ঠাকুর্দা। সেটা ছ’বছর আগের ঘটনা। তারপর আমার ভাই। অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম ভীষণভাবে।
পোয়ারো গভীর মনোযোগ দিয়ে নিকের প্রত্যেকটা কথা শুনছিল। মেয়েটা থামতেই আড্ডা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে-আর আপনার বাবা?
উনি যুদ্ধে আহত প্রতিবন্ধী অবস্থায় ফিরে এসেছিলেন। কয়েকবছর পরই নিউমোনিয়াতে মারা যান।
একটু থেমে নিক আবার যোগ করে–আমার শিশু বয়সেই মা মারা গিয়েছিলেন। মায়ের অকাল মৃত্যুর শোক বাবা সহ্য করতে পারেননি। তারপর থেকেই ভবঘুরে জীবনযাপন করতেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হতেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আমি বা আমার ভাই জেরাল্ড কেউই বাবার সঙ্গ পাইনি। ঠাকুর্দার কাছেই মানুষ হয়েছি। আমার ঠাকুর্দা ছিলেন একজন অতুলনীয় মানুষ। লোকে বলত তিনি যাতে হাত দিতেন তাই নাকি সোনা হয়ে উঠত। তিন তার ভাগ্য পরীক্ষা করতেন জুয়ায়। যার মাধ্যমে প্রচুর রোজগার করেছিলেন তিনি। আমার যখন ষোল বছর বয়স, তিনি মারা যান। তারপর এই বাড়ির মালিকানা পায় আমার ভাই জেরাল্ড। মাত্র বছর তিনেক আগে এক মোটর দুর্ঘটনায় জেরাল্ড মারা যায়।
আপনার পর এ বাড়ির মালিকানা পাবেন সেরকম নিকটাত্মীয় কি কেউ আছেন মাদাম জোয়েল? পোয়ারো প্রশ্ন করল।
নিক দ্রুত কয়েকমুহূর্ত ভেবে বলে–আমার সম্পর্কে এক ভাই চার্লস। চার্লস ভাইস। পেশায় ও একজন দক্ষ আইনজীবী। সব ব্যাপারে আমায় সে খুব সাহায্য করে।
আপনার বিষয় সম্পত্তির দেখাশোনা কি ইনিই করেন?
উফ, সেভাবে দেখতে গেলে দেখাশোনা করার মত বিষয় সম্পত্তি আমার সেরকম নেই। তবে হ্যাঁ, আমার বাড়িটা বন্ধক রাখতে চার্লসই সবরকম ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। লজটা ভাড়া দেবার ব্যবস্থাও সেই করে দিয়েছিল। উফ, লজ, আমি এক্ষুনি এ প্রসঙ্গে আসছিলাম।
ওটাও কি ভাড়া দেওয়া ম্যাদাম?
নিক সায় দেয়,– হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ান এক পরিবারকে। খুবই আন্তরিক এবং মিশুকে পরিবার।
পোয়ারো কি যেন চিন্তা করে। তারপর বলে–এখানে ওরা কতদিন ধরে রয়েছেন?
বেশিদিন নয়। মাত্র মাসছয়েক।
আচ্ছা ম্যাদাম, আপনার ওই ভাইটি, চার্লস–সে কি আপনার বাবার দিকের আত্মীয় না মায়ের?
ওহ, চার্লস আমার মায়ের দিকের সম্পর্কিত। আমার মাসতুতো ভাই।
পোয়ারো আবার ঘনঘন দু’পাশে মাথা নাড়ে সমর্থনের ভঙ্গিতে।
বেশ। এছাড়া আর অন্য আত্মীয়-স্বজন?
খুব কম। ইয়র্কশায়ারে কয়েকজন দূর সম্পর্কের ভাইবোন আছে।
হুম, তাহলে আপনার তো যথেষ্ট নিঃসঙ্গ জীবন কাটে তাই না?
পোয়ারোর কথায় মিস বার্কলি মৃদু হাসেন–নিঃসঙ্গ? না মিঃ পোয়ারো। আসলে সম্পর্ক তৈরি বা বজায় রাখার সময়ই আমার থাকে না। দেশে তো বলতে গেলে আমি প্রায় থাকিই না।
যাক, এবার আপনার বন্ধুদের বিষয়ে একটু জানব। দুপুরে আপনাকে যাদের সঙ্গে দেখলাম।
ওরা, একজন ফ্রেডি রাইস। আমার অন্যতম প্রিয় এবং ঘনিষ্ট বান্ধবী। ওর জীবনটা বলতে গেলে ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা জানোয়ারের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছিল। মদ আর মাদকই তার জীবন ছিল। বছর খানেকের মধ্যে ফ্রেডি তাকে ছেড়ে চলে আসে। আমি চাই আইনত বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেলে ফ্রেডি জিম লাজরুমকে বিয়ে করুক।
জিম লাজরুম? বন্ড স্ট্রিটের আর্ট ডিলার?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। জিম তার একমাত্র সন্তান। সুপুরুষ। সৎ। অত্যন্ত ভদ্র। সবচেয়ে বড় কথা, ফ্রেডি নিবেদিত প্রাণ। ওরা হোটেল ম্যাজেস্টিকেই রয়েছে গত একসপ্তাহ ধরে। আগামি সোমবার আমি একটা পার্টি দিচ্ছি। সেদিন ওরা এখানে আসবে।
পোয়ায়োর কপালে ভাঁজটা ক্রমে গম্ভীর হচ্ছে। আমি ওর এই চেহারা খুব ভালভাবেই চিনি। চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে পোয়ারো নিককে উদ্দেশ্য করে বলে–আর মিসেস রাইমের স্বামী?
সেই নেশাখোর হতচ্ছাড়ার তো কোন খোঁজই নেই। সে যে কোথায় কেউ জানে না। ফ্রেডিও সে কারণে ডিভোর্সটা পাচ্ছে না।
হুম। এবার মাদাম জোয়েল আপনার অন্য বন্ধুদের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। কমান্ডার শ্যালিঙ্গার?
জর্জ?–গত পাঁচ বছর ধরে আমি ওকে চিনি।
পোয়ারো এবার নিককে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে। এবার বন্ধুর মত প্রশ্ন করে–যদি কিছু মনে না করেন, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি আপনাকে–উনি কি আপনাকে বিয়ে করতে চান?
নিক সপ্রতিভ ভঙ্গিতেই ব্যক্তিগত প্রশ্নটার জবাব দেয়–হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই কথাটা তোলে।
এ বিষয়ে আপনার কি মত?
না, জর্জকে বিয়ে করার বাসনা আমার কোন মতেই নেই। কারণ ওর বিত্তসম্পদও নেই, বয়সও চল্লিশ পার হয়ে গেছে। তাছাড়া চরিত্রের দিক দিয়ে একটু একঘেয়ে স্বভাবের।
পোয়ারো মৃদু হাসে-সঠিক যুক্তি। আপনার মত একজন প্রাণোচ্ছল যুবতীর সঙ্গে উনি মোটেই মানানসই নন।
একটু থেমে পোয়ারো আবার বলে–আচ্ছা মাদাম যে ছবিটা আপনার বিছানার ওপর ছিঁড়ে পড়েছিল, সেটা কি একবার দেখা যায়?
নিক একঝলক পোয়ারোর মুখের দিকে তাকায় তারপর বলে–হ্যাঁ, কেন নয়?
নিকের পেছন পেছন আমরা ওর শোবার ঘরে এসে হাজির হলাম।
মাথার দিকে ওপরে ফ্রেমে বাঁধানো একটা তেলচিত্র। পোয়ারো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল–আগের দড়িটাও কি একইরকম পোক্ত ছিল?