.
০৩.
দুর্ঘটনা?
নিঃসন্দেহে, নিকের এই ভঙ্গিটা পোয়ারোর ইগোকে আঘাত করে। সারা পৃথিবী যাকে একডাকে চেনে, অথচ এই মেয়েটি তাকে আদৌ চেনে বলে মনে হচ্ছে না। সে দাবি করলেও সেটা আমাদের কারও কাছেই মোটেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না। সবচেয়ে বড় যেটা, মেয়েটা পোয়ারোর সাবধানবাণীকে আদৌ গুরুত্ব দিচ্ছে না। বয়ষ্ক বিদেশীটি যেন কোনও ভয়ানক মজা-কৌতুকের কথা বলছে। ভঙ্গিটা সেইরকম। নিকের এই অসন্তুষ্ট হওয়া, সেটা সত্যিই পোয়ারোর মত ব্যক্তিত্বের ইগোর পক্ষে মারাত্মক রকমের অস্বাস্থ্যকর।
পোয়ারোর গলাটা বজ্রনির্ঘোষের মত শোনায়।
আপনি কি একটু সিরিয়াস হবেন? আপনারা, এই অল্পবয়সীরা–কেন কোনও কথাতেই গুরুত্ব দেন না? একটু থেমে আগুনঝরা চোখে নিকের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো আবার বলে-মাদাম, আমার কথা শুনে আপনার নিশ্চয়ই খুব হাসি পাচ্ছে? অথচ মাথায় ছোট্ট একটা ফুটো নিয়ে আপনি যদি শুয়ে থাকতেন, তাহলে কিন্তু হাসতে পারতেন না। কারণ মৃতদেহ হাসে না।
নিক পোয়ারোর দিকে সংশয়ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। মিঃ পোয়ারো, আমাকে সাবধান করে দেবার জন্য ধন্যবাদ। তবে আমার সত্যি সত্যিই মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা নিছকই একটা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পোয়ারো হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়, সামান্য থমকে নিককে নিরীক্ষণ করে–আহ, আবার সেই কথা, এক কথা। সামান্য থেমে পোয়ারো এবার তীব্র গলায় ঝাঝালো ভঙ্গিতে বলে-মাদাম জোয়েল, দয়া করে আমার কথায় আপনাকে মনোযোগ দিতে অনুরোধ করছি। আপনি ভীষণ রকম বিপদের মুখোমুখি, সকালে কেউ আপনাকে মাউজার পিস্তর দিয়ে গুলি করেছিল।
নিমেষে নিকের চেহারায় ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়। পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকিয়ে সে অবাক গলায় বলে-মাউজার পিস্তল?
ওকে বিভ্রান্ত দেখায়।
হ্যাঁ, কেন? আপনি কি এরকম কাউকে চেনেন, জানেন, যার কাছে মাউজার পিস্তল রয়েছে?
নিক হাসে, আমার কাছেই আছে। হ্যাঁ, বাবা যুদ্ধ থেকে ফিরে আসায় দিয়েছিলেন।
একবার সেই বস্তুটা দেখতে পারি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
নিক উঠে যায়, বরাবর এটা এখানেই থাকে। সে একটা পুরানো আমলের দেরাজের বিশেষ একটা খোপের দিকে ইঙ্গিত করে। তারপর সেটা টেনে খুলতেই ওর মুখের ভাব সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। বিস্ফারিত চোখে চমকিত গলায় সে বলে-ও-ওটা নেই।
নিক (আমরা এতক্ষণে কথা প্রসঙ্গে জেনে ফেলেছি এটা ওর দাদুর দেওয়া নাম, ওর আসল নাম ম্যাগদালা) আবার চেয়ারে ফিরে এসে বসে। ওর মুখে ঘন চিন্তার রেখা। আশ্চর্য ছোট্ট শব্দটায় মনের ভাব প্রকাশ করে সে।
তোমার মনে আছে হিস্টেংস, আমি যে সম্ভাবনাটার কথা আগেই তোমায় বলেছিলাম। মনে পড়ছে?
আমি নিরাপদ থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে করি। প্রিয় বন্ধু আবার একটা নিজস্ব চাল দিয়েছে।
সামান্য বিরতি, পোয়ারো নিকের অভিব্যক্তিটা দ্রুত চোখে নিরীক্ষণ করে, তারপর আবার বলতে শুরু করে–আমার ধারণাটাই সত্যি হল। মাদাম জোয়েলের গুলিবিদ্ধ শরীরটা হোটেলের বাগানে নিথর হয়ে পড়ে থাকত। অনেকক্ষণ যা কারোর নজরে পড়ত না। সেই ফাঁকে, কাজটা খুবই সহজ পিস্তলটা ওর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত। পরে মাদাম এলিন যা সনাক্ত করতেন ওটা অবশ্যই মাদাম জোয়েল এরই পিস্তল এবং তিনি এও জানাতেন, সম্প্রতি মাদম জোয়েল খুব নার্ভাস, মৃত্যু ভয়ে ভীত ছিলেন।
নিক অস্বস্তির ভঙ্গিতে নড়ে। ওর মুখে-চোখে স্পষ্টতই সংশয়। পোয়ারো আবার বলতে শুরু করে। সুতরাং আবার বলতে ঘটনাটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। খুব সহজ হবে ব্যাপারটা।
কি ভয়ঙ্কর! নিকের গলায় স্পষ্ট আতঙ্ক।
পোয়ারো আমার দিকে তাকায়, ওর চোখে বিজয়ীর হাসি। মাথা নেড়ে নিজের আতঙ্ককে সমর্থন করেই যেন পোয়ারো বলে–আর একটা ব্যাপার, চার চারটে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে … পঞ্চমবার হয়তো সেটা হবে না।
নিক পোয়ারোর দিকে তাকায়। দুষ্টিতে সংশয়।
পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন-না, না, মিস বার্কলি, চিন্তা করবেন না। আমরা আছি। আপনাকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করব।
মিস বার্কলি সামান্য হাসেন-ধন্যবাদ। আপনি ভয় দেখান সুন্দরভাবে। ঘটনাগুলোর মতই বিপজ্জনক ধরনের, আবার রোমহর্ষক। আমি লক্ষ্য করছিলাম নিক তার নির্দয় অভিজ্ঞতাটাকে ধরে রাখলেও, বজায় রাখবার চেষ্টা করে চললেও-ওর দৃষ্টিতে স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে সমস্যার প্রতিচ্ছবি, বিপদের আঁচ।…
পোয়ারো মৃদু কাশে। তারপর বিনীত ভঙ্গিতে একটু ঝুঁকে বলে-তাহলে প্রথমেই যেটা করতে হবে, প্রথাগত আলোচনা। নিকের চোখে চোখ রাখে সে-তাহলে…..শুরু করা যাক মাদাম জোয়েল? প্রথমে যে প্রশ্নটা অবশ্যম্ভাবী এসে পড়ে, আপনার কোন শত্রু আছে?
নিক মাথা নেড়ে নেতিবাচক উত্তর দেয়, না।
পোয়ারো সমর্থনসূচক ভঙ্গি করে–বেশ। তাহলে আমরা সিনেমা বা গোয়েন্দা কাহিনীতে গোয়েন্দাকে এরপর যে প্রশ্নটা করতে শুনি-আপনার মৃত্যু হলে কার সবচেয়ে লাভ?
এবার নিককে দৃশ্যতই বিভ্রান্ত দেখায়।
সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। যে কারণে আমার গোটা ব্যাপারটাকে আজব, দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। আমার সেরকম কোনও সম্পত্তি নেই, যার কারণে আমাকে খুন করার চেষ্টা করা হতে পারে। হ্যাঁ, এই বাড়িটা আছে বটে কিন্তু পুরানো এই বাড়িটাও তো বন্ধক রাখা।