উনি আমার স্বামী। আবার বলে ফ্রেডরিকা। ভঙ্গিতে ক্লান্তি। লাজারুমের এগিয়ে দেওয়া চেয়ারটায় হেলান দিয়ে এলিয়ে বসে সে। গভীর একটা শ্বাস ছাড়ে এবার সব কথা খুলে বলবার সময় হয়েছে। এখনি।
আমার স্বামী ছিল এক ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে প্রকৃতির মানুষ। মাদকাসক্ত। ও-ই আমাকে ড্রাগ নেওয়া ধরায়। ওকে ছেড়ে আসবার পর থেকেই অভ্যাসটা ছাড়বার জন্যে আমি লড়াই করছি। শেষ পর্যন্ত, আমি প্রায় সেরে উঠছি। কিন্তু ওহ ব্যাপারটা কি কঠিন, প্রাণান্তকর। কেউ বুঝবে না সেটা কি কঠিন ব্যাপার। আমি কখনও, কোনদিন ওকে ছেড়ে আসতে, পালিয়ে সরে আসতে পারতাম না। সবসময় ও আমাকে ভয় দেখাত, টাকার দাবি করত, তারপর আমাকে গুলি করে মারবার, খুন করবার হুমকি দিত। ওর কোন দোষ নেই অবশ্য তাতে ও পুরোপুরিই মানসিক অসুস্থ ছিল। বিকৃত মস্তিষ্ক। একটু থেমে মাথা নীচু করে কি যেন ভেবে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে সে আমার ধারণা ম্যাগি বার্কলিকে ও-ই গুলি করেছিল। নিশ্চিতভাবেই, ওকে মারতে চায়নি। আমাকে ভেবেই গুলিটা ছোঁড়া হয়েছিল। প্রথমে আমি ধরেই নিয়েছিলাম নিককে হত্যার চেষ্টাগুলো আমার স্বামীই করছে। তারপর বুঝি, না, বোধহয় ওগুলো অন্য কারও কাজ। তারপর, হঠাৎ একদিন মঁসিয়ে পোয়ারোর টেবিলে একটা ছেঁড়া, দুমড়ানো কাগজে অতি পরিচিত একটা হাতের লেখা দেখতে পাই। আমাকে লেখা ওর চিঠির অংশ ছিল সেটা। তখনি আমি বুঝে যাই, মঁসিয়ে পোয়ারো সঠিক রাস্তাতে হাঁটতে শুরু করেছেন, এবং এরপর, সবকিছু প্রকাশিত হয়ে পড়াটা শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা।
আবার একটু থামে ফ্রেডরিকা। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে কিছুটা প্রশ্ন বা কৌতূহলের ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে কিন্তু চকোলেটের ব্যাপারটা আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। আমি কখনই কোনভাবে নিককে বিষ দেবার চেষ্টা করিনি। দুহাতে এবার নিজের মুখ ঢেকে ফেলে সে। হৃদয়বিদারক গলায় বলে ব্যাস, এইটুকুই। আর কিছু বলার নেই আমার।
.
২১.
এবং সেই ব্যক্তিটি, ‘ত’
লাজারুম সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত তার পাশে গিয়ে বসে বলে প্রিয়তমা? আমার প্রিয়তমা। পোয়ারো সেলারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এক গ্লাস ব্র্যান্ডি এনে ফ্রেডির হাতে তুলে দেয়। ফ্রেডি চুমুকে গ্লাস শেষ করে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসে তাহলে এখন? সে এবার জেপের দিকে তাকায়। জেপ এবার মাথা নাড়ে। যা করবার সেন্ট-লু পুলিশই করবে।
নিক আর্তস্বরে বলে মিঃ পোয়ারো ব্যাপারটাকে আমাদের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলা যায় না?
আপনি তাই চাইছেন মাদাম জোয়েল?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আর আমার ওপর নিশ্চয়ই আক্রমণ হবে না। তাই এসবের মধ্যে পুলিশকে না জড়ালেই নয় কি?
না, এটা সত্যি, আপনার ওপর আর আক্রমণ হবার সম্ভাবনা নেই। তবুও……..
আমি জানি। আপনি ম্যাগির কথা ভাবছেন। কিন্তু মিঃ পোয়ারো, আর কোন কিছুই তো ম্যাগিকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। শুধু শুধু ফ্রেডরিকাকে বিরাট একটা অপপ্রচারের মধ্যে টেনে এনে লাভ কি? বেচারার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এমনিতেই সারা জীবন প্রচুর কষ্ট সহ্য করেছে মেয়েটা। অনেক যন্ত্রণা পেয়েছে। আপনি শুনছেন ওনার এসব প্রাপ্য নয়?
পোয়ারো ঠাণ্ডা গলায় বলে নিশ্চয়ই নয়। স্বামী-হিসাবে লোটা একটা অপদার্থ, জঘন্য প্রকৃতির মানুষ ছিল। আপনারা আজ নিজের চোখেই তো দেখলেন কেমন চরিত্রের মানুষ ছিল সে। লোকটা মারা গেছে। ব্যাপারটাকে এখানেই শেষ করে দিন। পুলিশ ম্যাগির খুনিকে খুঁজুক। ওরা কোনদিনই তাকে খুঁজে পাবে না।
পোয়ারো এবার এলিনের দিকে ঘুরে তাকায়–তোমার কিছু বলার আছে?
দিব্যি করে বলছি আমার সন্তানের নামে, এ বিষয়ে আমি বা উইলিয়াম আমরা স্বামী-স্ত্রী কোন দিন, কখনো, কারো কাছে একটা শব্দও উচ্চারণ করব না।
পোয়ারো এবার ঘরের অন্য সবার দিকে এক এক করে তাকায় আপনাদের সবারও একই মত তো?
ঘরের সবাই, এমনকি ইন্সপেক্টর জেপ-ও পর্যন্ত নিকের ইচ্ছেতে সায় দেয়। শুধু একজন ছাড়া, চার্লস ভ্যাইস। চার্লস, প্রিয় ভাই। নিক আর্তস্বরে বলে।
দুঃখিত, আমি আইনের বিপরীতে হাঁটতে পারিনা।
পোয়ারো এবার উৎসাহের গলায় বলে ঠিক বলেছেন। আপনি বলিষ্ঠ চরিত্রের মানুষ। আমিও আপনার সঙ্গে একমত।
মিঃ পোয়ারো, প্লিজ নিক অনুনয়ের গলায় বলে।
দুঃখিত মাদাম জোয়েল। আপনি আমাকে এই কেসে টেনে এনেছিলেন। আপনার ইচ্ছেতেই আমি এসেছিলাম। কিন্তু এখন এই ভাবে আপনি আমাকে চুপ করিয়ে দিতে পারেন না। কিছুতেই না। পোয়ারো ওর মধ্যমা তীক্ষ্ণ শাসনের ভঙ্গিতে উঁচিয়ে তোলে। ওর ওই রুক্ষ্ম ভঙ্গিটা আমি খুব ভাল ভাবে চিনি, জানি। সবাই বসুন। এখন আমি বলব সত্যিটা। আসল সত্যিটা।
পোয়াহোর উদ্ধত শাসনের ভঙ্গিটা সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়। সবাই চুপচাপ চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগের ভঙ্গিতে পোয়ারোর দিকে তাকায়। Ecountez. আমি একটা দীর্ঘ তালিকা বানিয়েছিলাম। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আমি তাদের অক্ষরমালার ক্রমানুসারে ক’ থেকে জ’ পর্যন্ত চিহ্নিত করেছিলাম। সে তালিকায় অচেনা, রহস্যময় একজনও ছিল। ঝ’। আজ রাতের আগে পর্যন্ত যার পরিচয় আমরা কেউ জানতে পারিনি। যদিও আমি সব সময়ই নিশ্চিত ছিলাম এই অপরাধের সঙ্গে ঝ’ অবশ্যই জড়িত, সেরকম কেউ রয়েছেই। আজ রাতের ঘটনা প্রমাণ করল আমি সঠিক ছিলাম। কিন্তু গতকাল রাতে নতুন করে সব হিসেব করতে, অপরাধের অঙ্কটা নতুন করে সমাধান করতে বসেই প্রথমবার আমি বুঝতে পারি, আমি একটা বিরাট ভুল করে বসেছি। সন্দেহভাজনদের তালিকা থেকে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম বাদ দিয়েছি। ত’ এতদিন যাকে আমি ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনি।