তারপরই, একসাথে ঘরের সবগুলো আলো জ্বলে উঠল। পোয়ারোর মুখে দেখলাম একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেছে। যেন এক রিং মাস্টারের হাসি। সাদা ধবধবে ওড়না জাতীয় একটা গাউন পরে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিক। এক এক করে সবার মুখগুলো দেখছে।
সবার আগে ফ্রেডরিকাই কথা বলে। অবিশ্বাসের তীব্রতর ভঙ্গিতে হাত বাড়ায় সে, বন্ধুকে স্পর্শ করে নিক, নিক, তুমি সত্যি আসল।
নিক হাসে, এগিয়ে যায় হ্যাঁ, আমি সত্যি, যথেষ্ট আসল। তারপর সে মুখ ফেরায় আপনি আমার বাবার জন্যে যা করেছিলেন তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ মিসেস ক্রফট। কিন্তু আমি দুঃখিত, তার লাভটা এক্ষুনি আপনি পাচ্ছেন না।
হে ভগবান, ওহ হে ভগবান। মিসেস ক্রফট প্রায় খাবি খেতে থাকেন, চেয়ার থেকে পড়ে যাবার উপক্রম হয়, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল বার্ট নিয়ে চল। আমি রসিকতা করেছি মাত্র। শুধু রসিকতা, বিশ্বাস কর। খুবই সন্দেহজনক রসিকতা বাস্তবিক।
আবার দরজা খুলে যায় আর প্রায় নিঃশব্দে একজন মানুষ ঘরে ঢোকেন। আমি অবাক হয়ে যাই। ইন্সপেক্টর জেপ। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে তিনি মাথা নাড়েন কোন প্রশ্নের উত্তর মিলে যাবার তৃপ্ত ভঙ্গিতে। আর তারপরই তার মুখ নিমেষে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হুইল চেয়ারে বসা ভেঙ্গে পড়া, হতচকিত, প্রবল বিব্রত পঙ্গু মহিলাটির চেহারার দিকে নজর পড়তেই। দ্রুত ক্ষিপ্র পায়ে তিনি এগিয়ে যান। আরে আরে আরে, কি আশ্চর্য, এক পুরনো বন্ধু যে। মিলি মেরটন। আপনি তাহলে এখানে আপনার পুরনো খেলা শুরু করেছেন মাননীয়া?
মিসেস ক্রফট বিড়বিড় করে কি একটা কথা বলতে থাকেন। বড়ই ক্ষীণ দুর্বল সেই প্রতিবাদ। জেপ ধমকে ওঠেন, থামুন। আপনার জারিজুরি সব শেষ। তারপর পোয়ারোর দিকে ফিরে জেপ বলেন মাননীয়াটিকে চিনে রাখুন মঁসিয়ে পোয়ারো। এই সময়ের সবচেয়ে ধূর্ততম প্রতারক মিলি মেরটন। আমাদের কাছে খবর ছিল এক গাড়ি দুর্ঘটনায় উনি মারাত্মক আহত। কিন্তু উনি কোথায় আছেন জানতে পারা যাচ্ছিল না। পঙ্গু, আহত, হুইল চেয়ারে বসা অবস্থাতেও উনি প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এখানে। বাস্তবিক, জোচ্চুরির ক্ষেত্রে উনি একজন বিরাট মাপের শিল্পী মানতেই হবে।
তার মানে উইলটা জাল? একটা প্রতারণা? প্রবল বিস্ময়ের গলায় ভ্যাইস প্রশ্ন করেন।
অবশ্যই জাল। তুমি ভাবলে কি করে ওরকম বোকা বোকা, চরম অসঙ্গতিপূর্ণ একটা উইল আমি করব, করতে পারি। আমি এন্ড হাউস তোমাকে দিয়ে গিয়েছি চার্লস। বাকি সবকিছু ফ্রেডরিকাকে।
আর ঠিক তখনি ঘটল ব্যাপারটা। আচমকা।
জানালার বাইরে যেন একটা আগুনের ঝলক ঝলসে উঠল। তীব্র, কান ফাটানো একটা শিসের মত শব্দ। তারপর আরও একটা। জানালার বাইরে একটা মর্মভেদী আর্তচিৎকার আর কিছু একটা পড়ে যাবার শব্দ। এদিকে ফ্রেডরিকা তখন পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর কবজির কাছ থেকে রক্তের সরু ধারা নেমেছে।
২০. ঝ
২০. ঝ
পুরো ব্যাপারটা এত দ্রুত চোখের পলকে ঘটে গেল, যে প্রথমটা কেউ বুঝে উঠতেই পারল না। তারপর, অত্যন্ত হিংস্র একটা অভিব্যক্তি সহকারে পোয়ারো জানালার দিকে ছুটল। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার ওকে অনুসরণ করলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই ওরা দুজনে একটা নিথর পুরুষ শরীরকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। আরাম কেদারায় শরীরটাকে শুইয়ে দেবার পর, মুখটা দৃশ্যমান হতেই, আমার মুখ দিয়ে প্রায় একটা আর্ত চিৎকার ঠিকরে বের হয়ে এল, সেই মুখটা, জানালার সেই মুখটা। সাদাটে, দুর্বলতা মাখা, ফ্যাকাশে, প্রায় আধিভৌতিক একটা মুখ, যেন একটা মুখোশ। একবার দেখলেই যা মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। লোকটার মাথার পাশ দিয়ে রক্তের একটা ধারা নেমেছে। ফ্রেডরিকা ধীর পায়ে এগিয়ে চেয়ারে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
আপনি আহত মাদাম। পোয়ারো ওকে বাধা দিয়ে বলে-কিছু না। গুলিটা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। সামান্য ব্যাপার।
নীচু হয়ে ঝুঁকে পড়ে সে লোকটার মাথায় হাত রাখে। লোকটা এবার চোখ খোলে, ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, মানুষটার ঠোঁট দুটো বার কয়েক কেঁপে ওঠে, আশা করি তোমার জন্যে এবার আমি পেরেছি করতে। ফিসফিসিয়ে বলে সে। তারপরই, হঠাৎ তার গলার স্বর বদলে যায়, ওহ্ ফ্রেডি, আমি এরকমভাবে বলতে চাইনি, তুমি সবসময় এত ভাল ব্যবহার করেছ আমার সঙ্গে। প্রায় শিশুর স্বরে সে বলে।
ঠিক আছে, এটা কোন ব্যাপার নয়। লোকটির পাশে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ফ্রেডরিকা। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আমি এভাবে……….. কথাটা শেষ হয় না। লোকটার মাথাটা একপাশে হেলে যায়। ফ্রেডরিকা পোয়ারোর দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকায়।
হ্যাঁ, ম্যাডাম উনি মারা গেছেন। শান্ত গলায় বলে সে।
ফ্রেডরিকা অনুত্তেজিত, ধীর ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। একটা হাত লোকটার কপালে চুঁইয়ে রেখে গভীর দুঃখের ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর বুক চেরা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাদের দিকে, ঘরের অন্য সবার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় আমার স্বামী। শান্ত ভঙ্গিতে বলে।
ঝ’ আমার মুখ দিয়ে প্রায় অজান্তেই বের হয়ে আসে। পোয়ারো দ্রুত আমার মন্তব্যটাকে ধরে নেয় হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। ধীর শান্ত গলায় বলে প্রথম থেকেই আমি বলে আসছিলাম, কেউ একজন, ঝ’ নিশ্চয়ই আছে এইসব কিছুর মধ্যে বলিনি?