ভ্যাইস ঠাণ্ডা চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায় উইলটা পুরোপুরিভাবে আইনসঙ্গত। আমার বোনের করা তার সম্পত্তির বাটোয়ারাকে আইনি পথে বিরোধীতা করার কোন ইচ্ছে, আগ্রহই আমার নেই।
আপনি খুবই সৎ মানুষ। মিঃ ক্রফট সমর্থনের ভঙ্গিতে বলেন। আশ্চর্য করে দিল মেয়েটা। একবারের জন্যেও কখনও বুঝতে দেয়নি এই কাণ্ডটা করতে চলেছে।
স্বামীর কথায় মিসেস ক্রফট মাথা নাড়েন মিষ্টি মেয়েটা আমাদের অবাক করে দিতে চেয়েছিল।
ও হয়ত ওপর থেকে আমাদের দেখছে। আর ও যা চেয়েছিল, সেটাই ঘটতে দেখে হয়ত খুব খুশি হচ্ছে। পোয়ারো বলে। তারপর এক মুহূর্তের মধ্যে, যেন কি মনে পড়ে গেল, এভাবে বলে, যেন হঠাৎ কোন পরিকল্পনা মাথায় এল, আচ্ছা, আমরা আজ এখনি একটা প্রেতচক্রে বসলে হয় না? সবাই টেবিল ঘিরে বসে পড়ুন।
প্ল্যানচেট? মিসেস ক্রফট আঁতকে ওঠা গলায় বলেন, কিন্তু……… তার গলায় এখন একধরনের বিপন্নতা।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। হেস্টিংস, আমার প্রিয় বন্ধু এখানে আছে। ওর মধ্যে মাধ্যমশক্তি প্রচণ্ড (আবার আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন? আমি মনে মনে বলি), অন্য জগৎ থেকে বার্তা নিয়ে আসতে পারব আমরা। এ তো এক দারুণ সুযোগ। আমাদের এই সুযোগটাকে অবশ্যই কাজে লাগান উচিত। একটু থেমে পোয়ারো হাতে তালি বাজায়। ঘরের সবার দিকে ইঙ্গিত করে, তাড়াতাড়ি, টেবিলটার কাছে চেয়ার টেনে নিয়ে ঘিরে বসুন সবাই। আলো, আলোগুলো নিভিয়ে দেওয়া হোক।
অনেকেই যে খুব প্রসন্ন মনে বা সাহসের সঙ্গে পোয়ারোর নির্দেশ মানল তা বলা যাবে না। তবে পোয়ারোর ইচ্ছের কেউ বিরোধিতাও করল না। আসলে হয়ত ঘটনাচক্রের দ্রুততা, আকস্মিকতায় তারা এতটাই হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন যে প্রতিবাদ করা বা বিরোধিতা করার কথা ভাববারও সময় পাননি।
অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু করা হল। ঘর এখন ঘন অন্ধকার। টেবিল ঘিরে অজানা-অচেনা শঙ্কায় দুরু দুরু বক্ষ কয়েকটি মানুষ। যেহেতু গরমের রাত, জানালাগুলো খোলা থাকলেও পর্দাগুলো সব টেনে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে আবছা মৃদু একটা আলো ঘরে এসে পড়েছে। প্রায় ভুতুড়ে, রহস্যময়, আবছায়া পরিবেশ। নিস্তব্ধ ঘরে সবাই প্রায় মিনিট তিন শ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। তারপর ধীরে, খুব ধীরে টেবিলটা কাঁপতে শুরু করে (আমি মনে মনে পোয়ারোকে অভিসম্পাত দিই আমাকে এসব করতে হবে, ওর পুরো পরিকল্পনাটা, কেন আগে থাকতে আমাকে জানায়নি কিছু) আমার শ্বাস ভারী হয়ে ওঠে (সবাই সেটা শুনতে পায়, শুনতে পেতে বাধ্য করি নাটকীয়তা ব্যবহারে) ইতিমধ্যে অন্ধকারের সুযোগে পোয়ারো নিশব্দ পায়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমার কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলে চালিয়ে যাও। উনি বাইরে, টেরেসে চলে এসেছেন। খুব শিগগির নাটকের ওপর নাটক ঘটতে শুরু করবে।
আমি অন্য সবার মনের অবস্থানটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। অন্ধকারে, ঘরের কোথাও কিছু একটা, কিছু এসেছে, অপেক্ষায় আছে। কিছু একটা অভুতপূর্ব ঘটতে চলেছে। প্রতি মুহূর্তে শ্বাসরোধ করে তারই অপেক্ষা করে চলেছিল ঘরের প্রতিটি মানুষ। আমি নিজেও যথেষ্ট নার্ভাস বোধ করছিলাম। আমার তো তবু একটা ধারণা রয়েছে কি ঘটতে পারে, ঘটতে চলেছে। তবুও, আমার হৃৎপিন্ডটা মুখের কাছে এসে আটকে আছে মনে হচ্ছে। বাকিদের তাহলে কি অবস্থা? ঠিক এই সময়েই, ঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। প্রায় নিঃশব্দে (আগে থেকেই তেল দিয়ে বোধহয় তৈরি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবটা হল মারাত্মক) দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা দমকা হাওয়া ঘরে ঢুকে এল। বাগান থেকে বয়ে আসা সাধারণ হাওয়া। অথচ, মনে হল সবার শরীরে যেন একটা হিমশীতল মৃত্যুর স্পর্শ লাগল।
এবং তারপরই আমরা সবাই দেখতে পেলাম দরজার সামনে, আবছা ছায়ার মত প্রায় অবয়বহীন একটা আদল। নিক বার্কলি। এক ভৌতিক, অলৌকিকতার ভঙ্গিতে, নিঃশব্দে, ধীরে, প্রায় ভেসে আসবার মত, এগিয়ে আসতে থাকে সে। অমানুষিক এক দৃশ্য। যার প্রভাব স্বাভাবিক, নিশ্চিত, এবং প্রগাঢ়ভাবে ঘরে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মনের ওপর পড়ে। আমি মনে মনে তারিফ না করে পারি না। কি অসাধারণ একজন অভিনেত্রীকে পায়নি সিনেমা, হলিউড। নিশ্চিতভাবেই নিক তার এই নতুন চরিত্রে অভিনয় উপভোগ করছে। নিখুঁতভাবে তার প্রতিফলনও ঘটাচ্ছে। এন্ড হাউসে নিক একটা নাটক করতে চেয়েছিল। কি নাটক, তা আমি জানি না। তবে সেই নাটকের চেয়ে এই চরিত্রটা যে বেশ কয়েকগুণ বেশি ভাল, নাটকীয়তা ভরা তা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি।
প্রায় ভাসতে ভাসতে (সেটা কি করে, এখনও আমি জানি না) ঘরের মাঝখানে চলে এল। আর তখনি ঘরের থমথমে নৈঃশব্দ ভেঙ্গেচুরে খানখান হয়ে গেল। আমার পাশেই, হুইল চেয়ারটা থেকে কেমন একটা দম আটকে আসা কান্না জাতীয় শব্দ ভেসে এল। মিসেস ক্রফট। ঘড়ঘড়ে গলা আটকে আসা শব্দ। মিঃ ক্রফট। তীব্র চমকিত, আতঙ্কিত, ভগবানের নাম স্মরণ। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার ও লাজারুম সামনে ঝুঁকে পড়ে বিড়বিড় করতে থাকে। চালর্স ভ্যাইস দম দেওয়া পুতুলের মত চেয়ারে হেলান দিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র ফ্রেডরিকা রাইস, কোনরকম নড়াচড়া বা শব্দ করলেন না। এবং তারপরই তীক্ষ্ণ গলার একটা চিৎকার উঠল ফিরে এসেছে, সে ফিরে এসেছে। হাঁটছে, হাঁটছে। যাদের খুন করা হয়, তারা হাঁটে। তারা হাঁটে। আহ হে ভগবান…….